তির্যক চাহনি, বাঁকা হাসি, বিদ্রুপ: ঘরের বাইরে নারী কেন এত প্রশ্নের মুখে?

তির্যক চাহনি, বাঁকা হাসি, বিদ্রুপ: ঘরের বাইরে নারী কেন এত প্রশ্নের মুখে?


শামিমা শামিম প্রতিদিন কর্মস্থলে যান নিজের স্কুটিতে করে। নিজেই চালান। আজ আমি তার সঙ্গী হলাম। আমি খেয়াল করলাম, রাজধানী শহর ঢাকার রাস্তায় একটা মেয়ে স্কুটি চালিয়ে যাচ্ছে এটা যেন কারো নজর এড়াচ্ছে না। আরো খেয়াল করলাম ট্রাফিক সিগনাল বা জ্যামে থাকার সময় আশেপাশের আরোহীদের বাঁকা চাহনি। কয়েকজন রিক্সাচালকের ব্যাঙ্গাত্মক হাসি। শামিমা শামিম বলছিলেন এটা তার প্রতিদিনকার অভিজ্ঞতা। "যখন রাস্তায় বের হই তখন তারা স্কুটির চেয়ে আমার শরীরের দিকে বেশি চেয়ে থাকে। সব থেকে ভয়ংকর হল স্কুটি চালানোর সময় পিছন থেকে অনেক ছেলে আছে যারা মোটরবাইক নিয়ে টার্গেট করে, ধাক্কা দেওয়ার জন্য। আমার সাথে এমন ঘটনা অনেকবার হয়েছে। একবার তেজগাঁ লিংক রোডে ২/৩ টা বাইক এবং প্রতিটাকে তিনজন করে ছেলে। আমি দেখলাম আমার আর কোন জায়গা নেই। তখন আমি থেমে গেলাম। যদি আমি সচেতন না হয়ে একই গতিতে চালাতাম তাহলে ঐদিন নিশ্চিত আমার বড় একটা অ্যাকসিডেন্ট হত।" ঢাকায় রাস্তায় এখন অনেক মেয়েকেই স্কুটি চালাতে দেখা যায়, এমনকি মেয়েদের দ্বারা চালিত অ্যাপ ভিত্তিক রাইডও রয়েছে। শামিমা শামিম স্কুটি চালান আরো আগে থেকে। তখন হাতে গোনা দুই একজন নারীকে দেখা যেত চালাতে। তখনকার সাথে এখনকার কি কোন পরিবর্তন হয়েছে? শামিমা শামিম বলছিলেন "কোন পরিবর্তন হয় নি। এখন তো আমি চেষ্টা করি ১০টা মধ্যে বাসায় ফিরতে। কারণ বেশি রাত হলে রাস্তায় কী ধরণের দুর্ঘটনা ঘটে কে জানে। যে বাসায় থাকি সেখানেও অলিখিত একটা সান্ধ্য আইন জারি করা। ১০টার মধ্যেই বাসায় ফিরতে হবে। যেখানে আমার ছেলে বন্ধুরা রাত ১২টা পর্যন্ত শুধু মাত্র আড্ডা দেয়ার জন্য বাইরে থাকে সেখানে আমাকে মাথায় রাখতে হয় সব কাজ ফেলে ১০ টার মধ্যে বাসায় ফেরার তাড়া"। I


মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে মিলিত হয়েছেন বাংলাদেশ ওম্যান রাইডার্স ক্লাবের দুই সদস্যা। আর এখানেই প্রশ্ন উঠে 'কিন্তু কেন'?। পুরুষরা যদি বাইক চালিয়ে কর্মস্থলে যেতে পারেন বা কে কত পারদর্শী তার প্রতিযোগিতা হতে পারে তাহলে নারীরা নয় কেন? এত গেল দৈনন্দিন জীবনের রাস্তায় চলার ক্ষেত্রে ছোট একটা উদাহরণ। আরো অনেক গল্প আছে যেগুলো শুনলে অবুঝের মতই আপনার মনে প্রশ্ন উঠতে পারে কিন্তু কেন। বীনা রহমান। এই মেয়েটি বেসরকারি হাসপাতালে নার্সের কাজ করেন । কাজের প্রয়োজনে তাকে সপ্তাহে কয়েকদিন নাইট শিফট করতে হয়। কিন্তু প্রশ্নের মুখে পরতে হয় তাকেও। তিনি বলছিলেন "রাতে বের হয়ে যাই সকালে ফিরি। আমার আশে-পাশের ফ্ল্যাট থেকে আমার মা-কে জিজ্ঞেস করেছে আপনার মেয়ে এত রাতে কোথায় যায়? আসলেই আমি এই কাজ করি কিনা সেটা নিয়েও তাদের সন্দেহ।" ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ কল্যাণ ইন্সটিটিউটের শিক্ষক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হকের সাথে কথা বলতে। জানার চেষ্টা করছিলাম ঠিক কি কারণে সমাজে যে কাজ পুরুষ করতে পারে, নারী করতে গেলে তাকে কেন শুনতে হয় বিচিত্র, অশালীন কথা।


সন্ধ্যার পরেই মেয়েদের বাড়ী ফেরার তাড়া থাকে মি. হক বলছিলেন "নারীদের যে আচরণগুলো নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে সেটা একটা সাবলীল আচরণ। কিন্তু পুরুষ সদস্যরা সেটাকে স্বাভাবিকভাবে দেখছে না। এর কারণ হল পুরুষ সদস্যরা দীর্ঘদিন ধরে দেখছে মেয়েদের আচরণগুলো এই এই বৈশিষ্ট্য অনুসরণ করে হবে। মেয়েদেরকে একটা নির্দিষ্ট আচরণিক গণ্ডির মধ্যে দেখতে পছন্দ করে। এর বাইরে যদি কোন মেয়ে কোন আচরণ করে তখন সেটা তারা মেনে নিতে পারেনা। এমনকি আমাদের দেশে যারা নাগরিক নিরাপত্তায় নিয়োজিত তারাও এটা মেনে নিতে পারে না। কিন্তু মেয়েরা সেই সনাতনী পুরনো ধাঁচে চলতে থাকবে সেটা হতে পারে না।" যে প্রসঙ্গে কথা হচ্ছে এই প্রসঙ্গটি নতুন নয়। কিন্তু প্রতিবার নতুন নতুন পরিস্থিতির মুখে মেয়েদেরকে পড়তে হয়, যেটাকে পরিস্থিতি না বলে বলা উচিত হয়রানি, যৌনহয়রানি, শারীরিক, মানসিক হেনস্থার শিকার। সম্প্রতি একটা ভিডিও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে যেখানে ৬ মিনিটের বেশি সময় ধরে দেখা গেছে, কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে সিএনজির মধ্যে একজন নারীর নানা ধরণের অশালীন প্রশ্ন করতে। মেয়েটি র মধ্যরাতে কোথায় আসছিল....এ ধরণের নানা প্রশ্ন। আমি ঢাকায় নানা পেশার কয়েকজন নারী এবং পুরুষের সাথে কথা বলেছিলাম পুরুষের জন্য যেটা সাবলীল সেটা মেয়েদের জন্য স্বাভাবিক আচরণ নয় কেন? আরও পড়ুন: নারীদের ফেসবুক গ্রুপ: যেখানে একে অপরের সহায়ক বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে মেয়েরা কিভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে? বাংলাদেশে বাড়ছে নারী-প্রধান পরিবার একজন পুরুষ বলছিলেন "যেমন ধরেন আমি অনায়াসে আমার বন্ধু-বান্ধবীদের সাথে সাজেক চলে যাচ্ছি বেড়াতে। কিন্তু আমার বোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, সে যদি যেতে চায় তাহলে আমি যেতে দিচ্ছি না।" প্রশ্ন-কেন দিচ্ছেন না? উত্তর: "এই সুযোগটা ছোটবেলা থেকে আমাদের পরিবার প্রথম নষ্ট করে দেয়। আমি দেখে এসেছি মেয়েরা সন্ধ্যার পর বাইরে থাকতে পারবে না। আমি খেলা করে রাত নয়টায় আসলেও ক্ষতি নেই"। আরেকজন পুরুষ বলছিলেন "আমরা একটা সাইকোলজিক্যাল জায়গায় আটকে আছি। আমার বোন বা বাড়ির মেয়েরা যদি রাত ১১টায় বাসায় ফেরে তাহলে আমি মেনে নিতে পারবো না। যদিও আমি বুঝতে পারছি আমার মত তারো মবিলিটি দরকার"। কেন মেনে নিতে পারছেন না?

যে কাজ পুরুষরা করেন সেই কাজ নারীরা করলেই প্রশ্নের মুখে পড়েন উত্তর: "এক্ষেত্রে আমার মাথায় কাজ করে তার সিকিউরিটির কথা। আমাদের দেশে সেই নিরাপত্তাটা নিশ্চিত করা হয় নি"। তবে কয়েকজন নারী আমাকে বলছিলেন তারা যে শুধু পুরুষদের কাছ থেকেই এই ধরণের প্রতিক্রিয়া পেয়ে থাকেন তাই নয়। অনেক নারীদের কাছ থেকে শুনতে হয় একই রকম অপমানসূচক মন্তব্য। একটি মেয়ে আমাকে বলছিলেন "পরিবারের মধ্যেই বয়োজেষ্ঠা যেসব মহিলা থাকেন তারা এগুলো করেন। এমনকি আত্মীয় স্বজন যারা আছেন তারা বলেন মেয়ে মানুষের এই কাজ করার কি দরকার"। আরেকজন মেয়ে বলছিলেন "আমি আমার কথা বলতে চাই, আমি যদি কোথাও যেতে চাই তাহলে আমার মা বা বাড়ির মহিলারা বলে সাথে কাওকে নিতে। আমি একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারী আমাকে কেন অন্যের সাহায্য নিতে হবে? যখন আমার ভাই বাড়ির বাইরে যায় তখন তো সেটা বলা হয় না"। একজন নারী সাংবাদিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমাকে বলছিলেন অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের জন্য তাকে বিভিন্ন সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানে যেতে হয়। দেখা যায় অফিস সময় শেষ হয়ে গেলেও সেখানে তাকে কাজের খাতিরেই থাকতে হয় কিন্তু যখন সে বের হয়ে যায় তখন সে প্রতিষ্ঠানের সহকারী থেকে শুরু করে অন্যান্য কর্মকর্তাদের চোখেও অশালীন চাহনি বা মাঝে মাঝে তির্যক/অশালীন মন্তব্য করতে শোনে। তার প্রশ্ন এই একই কাজ তার পুরুষ সহকর্মীরাও করছে সংবাদ সংগ্রহের ক্ষেত্রে কিন্তু তাদের কেন এই অশালীন চাহনি বা মন্তব্য শুনতে হয় না?


অনেক পেশা আছে যেখানে নারীদের রাতে কাজ করতে হয় ঝালকাঠির একটি স্কুলের শিক্ষিকা শিরিন শারমীন। তিনি বলছিলেন রাজধানী ঢাকা শহরের মত ঢাকার বাইরেও একই রকম পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয় মেয়েদের। তিনি বলছিলেন এই পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসতে হলে প্রথমত দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। মিজ শারমীন বলছিলেন "আমি একজন শিক্ষক হিসেবে বলতে চাই এর পরিবর্তন করতে হলে গোড়া থেকে অর্থাৎ পরিবার থেকে কাজ শুরু করতে হবে। সেখানে মেয়ে অথবা ছেলেদের আলাদা করে দেখার কোন সুযোগ যাতে তৈরি না হয় সে ব্যাপারটা যথেষ্ট শক্ত ভাবে শিখিয়ে দিতে হবে। এরপর স্কুল। কারণ স্কুলে পঞ্চম,৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়া ছেলেদের মধ্যে আমি দেখেছি তার মেয়ে সহপাঠীদের অবজ্ঞা করতে। স্কুল পর্যায়ে প্রথম থেকে পদক্ষেপ নিতে হবে"। তবে এসব ভুক্তভোগি নারী এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মেয়েদের বিভিন্ন রকম অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মুখে যাতে পরতে না হয় সেজন্য দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করার উপর যেমন জোর দিচ্ছেন তেমনি নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার কথা বলছেন। না হলে এই অবস্থা পরিবর্তন হতে আরো অনেক বছর অপেক্ষা করতে হবে।

Post a Comment

0 Comments

Update Posts

“স্বাস্থ্য বিধি মেনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার দাবি এখন সার্বজনীন  ” দুলাল চন্দ্র চৌধুরী   প্রধান শিক্ষক ইস্কাটন গার্ডেন উচ্চ বিদ্যালয় ও সাংগঠনিক সম্পাদক
Checking the proxy and the firewall Running Windows Network Diagnostics ,unexpectedly closed the connection.This Site Can't Be Reached ERR_CONNECTION_REFUSED in Google chrome- Fixed easily
Contract Us
Samorita Hospital Ltd. Location Phone Address শমরিতা হাসপাতাল
✅ Error 522 Utc Connection Timed Out - Fix Website Success
Blogger WhatsApp Group Links 2021 | Youtubers WhatsApp Group Links
The Top 22 Pay-Per-Click PPC Advertising Networks
ঢাকা টু কলকাতা বাস ভাড়া ও সময়সূচী ২০২৪ অনলাইনে বাস, ট্রেন ও এয়ার টিকিট কাটবেন যেভাবে গোপালগঞ্জ থেকে কলকাতা  কোন কোন পরিবহন যায়
Top 10 Social Sharing Buttons for Your Website Software worldbd
করোনা ভাইরাস: কোথায় নমুনা দেবেন বিদেশগামী যাত্রীরা? ঠিক সময়ে ফলাফল পাবেন তারা?