কালিদাস পন্ডিত এর জীবনী | Biography Of Kalidas Pondit In Bangla,kalidas story

 

Bangla,kalidas story

কালিদাস
 (আনু. খ্রি.পূ ১ম/খ্রিস্টিয় ৪র্থ শতক)  বাল্মীকি-ব্যাসের পরে সর্বাধিক খ্যাতিসম্পন্ন সংস্কৃত কবি ও নাট্যকার। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ও আবির্ভাবকাল সম্পর্কে নানারকম মতবাদ প্রচলিত আছে। একপক্ষ তাঁকে খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকের কবি বলে মনে করে। এ ক্ষেত্রে তাঁর মালবিকাগ্নিমিত্র নাটক প্রধান সূত্র হিসেবে কাজ করেছে, কারণ এ নাটকটি ওই সময়কার শূঙ্গবংশীয় রাজা অগ্নিমিত্রের কাহিনী অবলম্বনে তাঁরই জীবদ্দশায় রচিত বলে গবেষকদের ধারণা। অপর একটি মতে কালিদাস খ্রিস্টিয় চতুর্থ শতকে জন্মগ্রহণ করেন এবং কথিত হয় যে, তিনি উজ্জয়িনীর রাজা বিক্রমাদিত্যের সভার নবরত্নের অন্যতম ছিলেন। তাঁর জন্ম সম্পর্কে অনেক মতবাদের মধ্যে এ দুটিই প্রধান।

কালিদাসের জন্মকালের মতো জন্মস্থান নিয়েও বিতর্ক আছে। কারও কারও মতে তিনি ছিলেন পশ্চিম মালবের অধিবাসী; আবার কেউ কেউ তাঁকে বাঙালি বলেও মনে করেন।

কালিদাসকে নিয়ে অনেক কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। কথিত হয় যে, বাল্যকালে অনাথ হয়ে পড়লে গো-পালকরা কালিদাসকে লালনপালন করে। ফলে তাঁর বিদ্যার্জনের সুযোগ হয়নি। কিন্তু ঘটনাচক্রে এক বিদুষী রাজকন্যার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। দুর্বিনীতা রাজকন্যাকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য মন্ত্রীর পরামর্শে রাজা এ বিয়ে স্থির করেন। বিয়ের পর কালিদাসের মূর্খতার কথা জেনে রাজকন্যা মর্মাহত হন। কিন্তু তিনি কালিদাসকে কালিকাদেবীর আরাধনা করে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য অনুপ্রাণিত করেন। দেবী কালিদাসের আরাধনায় প্রসন্ন হয়ে তাঁকে আশীর্বাদ করেন। এরপর কালিদাস লেখাপড়া শিখে  বেদ,  রামায়ণ,  মহাভারত,  পুরাণ, ইতিহাস,  কাব্য, অলঙ্কার,  ছন্দ,  ব্যাকরণ,  জ্যোতিষ, দর্শনশাস্ত্র, অর্থশাস্ত্র ইত্যাদি বিষয়ে পারদর্শী হয়ে ওঠেন এবং তাঁর মধ্যে অভিনব কবিত্বশক্তির প্রকাশ ঘটে। পরবর্তীকালে তিনি নিরবচ্ছিন্নভাবে সাহিত্য সাধনা করেন এবং তাঁর রচনায় অধীত বিদ্যার গভীর প্রভাব পড়ে।

কালিদাস একাধারে নাট্যকার এবং মহাকাব্য ও গীতিকাব্যের রচয়িতা। তাঁর রচনাবলির মধ্যে অভিজ্ঞানশকুন্তল, বিক্রমোর্বশীয় এবং মালবিকাগ্নিমিত্র  নাটক, রঘুবংশ ও কুমারসম্ভব মহাকাব্য এবং মেঘদূত ও ঋতুসংহার গীতিকাব্য সাহিত্যমাধুর্যে অতুলনীয়। রঘুবংশ মহাকাব্যে তিনি রঘুর দিগ্বিজয় উপলক্ষে প্রাচীন বঙ্গের অনেক বর্ণনা দিয়েছেন। তাঁর মেঘদূত কাহিনীকাব্যটি দেশে-বিদেশে বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। মেঘের মাধ্যমে বিরহিণী প্রিয়ার নিকট এক নির্বাসিত যক্ষের বার্তা প্রেরণ মেঘদূত কাব্যের উপজীব্য। পূর্বমেঘ ও উত্তরমেঘ এ দুটি অংশে কাব্যটি বিভক্ত। কালিদাসের পরবর্তী অনেক বাঙালি কবি মেঘদূতের অনুকরণে বহু কাব্য রচনা করেছেন। এতদ্ব্যতীত শ্রুতবোধ, নলোদয়, পুষ্পবাণবিলাস, শৃঙ্গারতিলক, জোতির্বিদাভরণ প্রভৃতি গ্রন্থ কালিদাসের নামে প্রচলিত থাকলেও সুধীসমাজে তা সর্বৈবভাবে স্বীকৃত নয়। কালিদাসের রচনা  বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গসহ সমগ্র ভারতে ব্যাপকভাবে চর্চিত হয়। বাংলাদেশের টোল-চতুষ্পাঠী এবং অনেক কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর গ্রন্থগুলি সংস্কৃত বিষয়ের পাঠ্যতালিকার অন্তর্ভুক্ত।

ব্রহ্মা,  বিষ্ণু ও মহেশ্বর এ ত্রয়ীর উপাসনায় কালিদাসের প্রগাঢ় অনুরক্তি থাকলেও তিনি মূলত নির্গুণ ব্রহ্মেরই উপাসক ছিলেন। তাঁর রচনা থেকে এ বিষয়টি অনুমান করা যায়। কালিদাস বর্ণাশ্রমধর্মের সমর্থক ছিলেন। মানবজীবনে সংযম ও স্বার্থত্যাগের প্রয়োজনীয়তা তিনি বিশেষভাবে উপলব্ধি করেছিলেন।

কালিদাসের রচনায় প্রাচীন ভারতের এক অভিজাত সমাজের চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি সংস্কৃত ভাষাকে সমৃদ্ধ করে বিশেষ মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি তাঁর কাব্যে প্রায় ৩০টির মতো ছন্দ ব্যবহার করেছেন। শিল্পরূপময়তা, অর্থের গভীরতা ও কল্পনার ব্যাপকতা তাঁর সকল রচনাকে রসোত্তীর্ণ করেছে। তাঁর অভিজ্ঞানশকুন্তল নাটকের ইংরেজি অনুবাদের (১৭৮৭) মাধ্যমে পাশ্চাত্য প্রথম ভারতীয় সাহিত্য সম্পর্কে ধারণা লাভ করে। অসাধারণ কবিপ্রতিভার জন্য কালিদাস হোমার, শেক্সপীয়র, মিলটন, দান্তে, গ্যেটে, ভার্জিল প্রমুখ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কবি-সাহিত্যিকের সমপর্যায়ভুক্ত।  [সমবারু চন্দ্র মহন্ত]

 

মূর্খ কালিদাসের মহাকবি হয়ে ওঠার গল্প

বাংলা ভাষার প্রধান উৎস হচ্ছে সংস্কৃত ভাষা। আরও সহজভাবে বললে সংস্কৃত ভাষা থেকেই বাংলা ভাষার উৎপত্তি। আর সেই সংস্কৃত ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ কবি হলেন মহাকবি কালিদাস। প্রাচীন ভারতেরও তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ কবি। এটাই কালিদাস পণ্ডিতের সবচেয়ে বড় পরিচয়। তবে আমাদের সাথে কালিদাস পণ্ডিতের পরিচয়টা হয়ত ঘটেছে অন্যভাবে। আর সেটা হচ্ছেধাঁধাঁ বর্তমানে ধাঁধাঁর প্রচলন কমে গেলেও আমাদের বাল্যকাল কেটেছে মজার মজার ধাঁধাঁর খেলায়। আর কালিদাসের ধাঁধাঁ ছাড়া যেন ধাঁধাঁর আসর জমতোই না। যেমন, কালিদাস পণ্ডিতে কয় বাল্যকালের কথা/ নয় হাজার তেঁতুল গাছে কয় হাজার পাতা? কিংবা, কালিদাস পন্ডিতের ফাঁকি/ আড়াইশ থেকে পাঁচ পঞ্চাশ গেলে/ আর কত থাকে বাকী? যদিও এসব ধাঁধাঁ আদৌ কালিদাস পণ্ডিতের কিনা তা নিয়ে বিস্তর সন্দেহ আছে, তবে এতটুকু অস্বীকার করার উপায় নেই যে, তিনি প্রতিভাধর ছিলেন বিধায়ই তার নামে এসব ধাঁধাঁ প্রচলিত হয়ে আসছে। কালিদাসের উপমা আর যুক্তিতে মুহ্যমান হয়ে এভাবেই তাকে কুর্নিশ করতেন সবাই;

কালিদাসের জন্মবৃত্তান্ত সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায় না, মানে ইতিহাসবিদগণ তার জন্ম সম্পর্কিত তথ্যের ব্যাপারে কোনো ঐক্যমতে পৌঁছাতে পারেননি। তার জন্মস্থান এবং জন্ম সন নিয়ে নানা মতামত প্রচলিত আছে। এজন্য আমরা ইতিহাসবিদদের অভিযুক্ত না করে বরং স্বয়ং কালিদাসকেই অভিযুক্ত করতে পারি! এত এত কবিতা লিখে গেলেন, অথচ একটি বইয়ের পেছনে নিজের জন্মবৃত্তান্তটা একটু লিখে যেতে পারলেন না? হা হা, আজকাল লেখকরা তো নিজের পরিচয়টা নিজেই লিখে দেন বইয়ের পেছনে! কালিদাসের মতো একজন মহাকবির জন্ম-মৃত্যু কিংবা জন্মভূমি সম্পর্কে জানার শখ হয়তো রবীন্দ্রনাথেরও ছিল। এজন্যই রবীন্দ্রনাথ তার ক্ষণিকা কাব্যের সেকাল কবিতায় লিখেছেন- হায় রে কবে কেটে গেছে কালিদাসের কাল! পণ্ডিতেরা বিবাদ করে লয়ে তারিখ-সাল। হারিয়ে গেছে সে-সব অব্দ, ইতিবৃত্ত আছে স্তব্ধ- গেছে যদি আপদ গেছে, মিথ্যা কোলাহল। হায় রে গেল সঙ্গে তারি সেদিনের সেই পৌরনারী নিপুণিকা চতুরিকা মালবিকার দল। কোন্স্বর্গে নিয়ে গেল বরমাল্যের থাল! হায় রে কবে কেটে গেছে কালিদাসের কাল! কালিদাস কবে জন্মেছেন আর কোথায় জন্মেছেন তা নিয়ে দেশি-বিদেশি গবেষকরা অসংখ্য বই লিখেছেন। একেকজনের একেক রকমের দাবী! কেউ বলেছেন, যিশুখ্রিস্টের জন্মের অনেক আগেই কালিদাসের জন্ম হয়েছে। তাদের মতে, কালিদাসেরমালবিকাগ্নিমিত্রমগ্রন্থের নায়ক অগ্নিমিত্র ছিল শুঙ্গ বংশীয় রাজা, বাস্তবে রাজার শাসনামল ছিল যিশুখ্রিস্টের জন্মের অনেক আগে, আর এই নাটকটি অগ্নিমিত্রের জীবদ্দশায়ই রচিত হয়েছিল, তাই কালিদাসের জন্য অবশ্যই যিশুখ্রিস্টের জন্মের আগে।

 

কালিদাসের ভাস্কর্য; আবার কেউ কেউ বলেছেন, না, যিশুখ্রিস্টের জন্মের অনেক পরে কালিদাসের জন্ম। তাদের মতে, কালিদাসের জন্ম হয়েছিল খ্রিস্টীয় চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ শতকের মাঝামাঝি। কেননা, কালিদাস বিক্রমাদিত্য নামে পরিচিত এক গুপ্ত সম্রাটের সভাকবি ছিলেন। কালিদাসের অনেক রচনায় চন্দ্রগুপ্তের রাজ্য, রাজধানী উজ্জয়িনী রাজসভার উল্লেখ পাওয়া যায়। সেখানেও সমস্যা হচ্ছে, 'বিক্রমাদিত্য' নাম দ্বারা আসলে সুনির্দিষ্ট কিছু বোঝার উপায় নেই। ভারতবর্ষের প্রাচীন ইতিহাসে অন্তত ছয়জন রাজা 'বিক্রমাদিত্য' উপাধি ধারণ করে রাজ্য পরিচালনা করেছিলেন। ফলে, আমাদের জন্য কালিদাস সম্বন্ধীয় বিক্রমাদিত্যকে খুঁজে বের করাও বেশ কঠিন কাজ। তবে অধিক প্রচলিত মত হচ্ছে, গুপ্ত সাম্রাজ্যের সর্বাধিক খ্যাতিমান নৃপতি দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত, যার উপাধি ছিল 'বিক্রমাদিত্য', তার সভাকবি ছিলেন কালিদাস। আর এই রাজার রাজত্বকাল ছিল ৩৭৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৪১৪ খ্রিস্টাব্দ। তারপরেও মূল কথা হচ্ছে, কালিদাস কবে জন্মেছিলেন সেই তথ্য কেউই সঠিক ভাবে বলতে পারবে না। তাই আমরা সেসব তর্ক থেকে নাহয় দূরেই থাকলাম। জন্মসালের মতো তার জন্মস্থান নিয়েও নানা বিতর্ক রয়েছে। অনেক গবেষকের মতে, উজ্জয়িনী। সেকালে মালব রাজ্যের রাজধানী ছিল, যা এখন মধ্যপ্রদেশের একটি জেলা শহর। আবার অনেক গবেষকের মতে, বিদিশা, আধুনিককালে যার নামকরণ করা হয়েছে ভিলশা, এটিও মধ্যপ্রদেশের একটি শহর। আবার কেউ বলেন, দেবগিরি পাহাড়ের কাছে দশোর গ্রামে কালিদাসের জন্ম। কেউ কেউ বলেন, বিদর্ভ, যা এখন 'বেয়ার' বলে সকলে চেনে, এটিও এখন মহারাষ্ট্রের একটি প্রদেশ। আবার সংস্কৃত গবেষক লক্ষ্মী ধর কল্লার মতে, তিনি কাশ্মীরে জন্মগ্রহণ করেন। তবে এসব তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়ে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে যায় যে, কালিদাস জন্মেছিলেন ভারতের কোনো এক জায়গায়। এছাড়া এর পেছনে আরেকটি যুক্তি দেয়া যেতে পারে কালিদাসের কাব্যের ভেতর থেকেই; তা হলো, কালিদাস অন্ততপক্ষে চার বার ভারত পরিভ্রমণ করেছিলেন এবং কখনো একই পথে দ্বিতীয়বার যাননি। সব মিলিয়ে ধারণায় উপনীত হওয়া যায় যে, মধ্যপ্রদেশ বা এর আশেপাশে তার জন্ম হয়েছিল। তবে মজার ব্যাপার হলো কালিদাস বাস্তবে একজন অশিক্ষিত-মূর্খ মানুষ ছিলেন। নিজের স্ত্রীও তার বোকামি নিয়ে হাসি-তামাশা করত। রাগে ক্ষোভে তিনি একবার আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছিলেন। কথিত আছে, এমতাবস্থায় তিনিও দস্যু রত্নাকরের মতোকালি দেবী মতান্তরে সরস্বতীর আশীর্বাদ পেয়েছিলেন। এতেই মূর্খ কালিদাস হয়ে উঠলেন মহাকবি কালিদাস! ছোটবেলায় বাবা-মা হারান কালিদাস। সর্বহারা শিশু কালিদাসের লালন-পালনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন রাখাল গোত্রের লোকজন। রাখালদের কাছে লালিত-পালিত হওয়ায় কালিদাসের লেখাপড়ার কোনো সুযোগ হয়ে ওঠেনি। কিন্তু তিনি দেখতে-শুনতে ছিলেন খুবই সুদর্শন। এতটাই সুদর্শন ছিলেন যে তাকে রাজপুত্রের মতো লাগত। আর সে কারণেই তার বিয়ে হয় এক সুন্দরী রাজকন্যার সঙ্গে। বিয়ে নিয়েও একটি মজার ঘটনা প্রচলিত আছে। কথিত আছে, উক্ত রাজকন্য নাকি রাজার খুবই অবাধ্য ছিলেন, তাই মন্ত্রীর পরামর্শে রাজা তার কন্যাকে শায়েস্তা করার জন্য কালিদাসের সাথে বিবাহ দিয়ে দেন। রাজপুত্রের মতো চেহারা থাকলেও বাস্তবে কালিদাস ছিলেন লেখাপড়া না জানা এক মূর্খ যুবক। নিজের ভাল-মন্দ বিচার করার মতো ক্ষমতাও ছিল না তার। একদিন কিছু লাকড়ির দরকার হলে কালিদাস গাছে উঠে গাছের যে ডালে বসে আছেন সেই ডালটিই কাটতে শুরু করলেন। উক্ত গাছের নিচ দিয়ে যাওয়ার সময় এক পথিক কালিদাসের এমন বোকামি দেখে তাকে ডাল কাটার সঠিক উপায় বলে দিলেন, কিন্তু কালিদাস এতটাই মূর্খ ছিলেন যে, পথিকের পরামর্শও তিনি অনুধাবন করতে ব্যর্থ হন। ডাল কাটতে গিয়ে ডালের সাথে কালিদাস নিজেও মাটিতে পড়ে আহত হন। বোকামির এমন সংবাদ সারা এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।

 

 মূর্খ কালিদাসের ডাল কাটার দৃশ্য;

এমনিতেই বোকামির জন্য কালিদাস প্রতিদিন স্ত্রীর কাছে বকা-ঝকা শুনতেন। ডাল কাটার বোকামি যেন তা আরও উস্কে দিল। স্ত্রীর এমন ব্যবহারে কালিদাস একদিন রাগে, ক্ষোভে, দুঃখে, অপমানে ঘর থেকে বের হয়ে আত্মহত্যা করার জন্য নদীতে ঝাপ দিলেন। কিন্তু তিনি সেখানেও ব্যার্থ। নদী থেকে তাকে উদ্ধার করলেন দেবী কালি, আর সেই কৃতজ্ঞতায় তিনি হয়ে গেলেন দেবীর 'কালি' দাস। সে অনুসারেই তার নাম হয়ে গেল কালিদাস। শুধু যে দেবী কালি তার জীবন বাঁচালেন তা- নয়, তাকে দিলেন জ্ঞান বুদ্ধির আশীর্বাদ, তাতেই কালিদাস হয়ে উঠলেন মহাকবি। রামায়ণ রচয়িতা বাল্মীকির দস্যু থেকে সাধক হয়ে ওঠার গল্পের মতো কালিদাস মূর্খ থেকে হয়ে উঠলেন মহাকবি। তার বুদ্ধির তারিফ করতে গিয়ে তার নামে আজও প্রচলিত আছে হাজার হাজার জটিল ধাঁধাঁ। তিনি হয়ে উঠলেন প্রাচীন ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি নাট্যকার। কালিদাস দুটি মহাকাব্য লিখেছেন- ‘রঘুবংশম্এবংকুমারসম্ভবম্ নাটক রচনা করেছেন তিনটি- ‘বিক্রমোর্বশীয়ম্’, ‘মালবিকাগ্নিমিত্রম্আরঅভিজ্ঞানশকু্ন্তলম্ গীতিকাব্য লিখেছেন দুটি- একটি হলো 'মেঘদূতম্', যাকে আমরা বাংলায় 'মেঘদূত' বলে জানি এবং অন্যটির নাম 'ঋতুসংহারমা'

 

মালবিকাগ্নিমিত্রম্নাটকের একটি দৃশ্য;

কালিদাসের রচনাবলীর মধ্যে আমাদের কাছে দুটি গ্রন্থ সবচেয়ে বেশি পরিচিত। এর মধ্যে আজ থেকে প্রায় দেড়শো বছর আগে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর গল্পের আকারে 'শকুন্তলা' লিখেছিলেন 'অভিজ্ঞানশকুন্তলম্' থেকে ভাবানুবাদ করে। আর অন্যটি হচ্ছে 'মেঘদূতম' বা 'মেঘদূত' বাংলায় পর্যন্ত বহুজন এই ছোট্ট কাব্যগ্রন্থটির অনুবাদ করেছেন। সংক্ষিপ্ত হলেও এটিই তার অমর কীর্তি; তার শ্রেষ্ঠ রচনা হিসেবে স্বীকৃত। 'মেঘদূতে' বিষয়বস্তু নিয়ে হায়াৎ মামুদ লিখেছেন, ছোট একটি গল্প, এবং একেবারেই বিশ্বাস করার মতো নয়। কুবের নামে কোটিপতি এক লোকের বাড়িতে চাকরি করে এক যক্ষ। গৃহভৃত্যটির নাম পর্যন্ত বলা হয়নি। 'যক্ষ' হলো লোকটির জাত-পাতের পরিচয়- যেমন জেলে, কুমোর, রাঁধুনি ইত্যাদি। যক্ষ বিয়ে করেছে সবেমাত্র। নতুন বৌ, ঘরসংসার গোছগাছ করায় যক্ষ ব্যস্ত। এর ফলে চাকরির কাজে বেচারার ত্রুটি ঘটতে লাগল। তখন রেগেমেগে কুবের তাকে শাস্তি দিল। তারা ছিল অলকাপুরীতে। অলকাপুরী হলো মানসসরোবরের কাছে কৈলাস পর্বতে এক শহর। কুবের তাকে সোজা পাঠিয়ে দিল রামগিরি পাহাড়ে। প্রথমত, অত্যন্ত দূর। কেননা উত্তর প্রদেশের দক্ষিণাংশ মধ্যপ্রদেশের সংযোগস্থলে এর অবস্থান। দ্বিতীয়ত, জায়গাটি পাহাড়ি অরণ্যাঞ্চল। রাজধানী থেকে এসে এরকম বুনো জায়গায় একটি বৎসর একা একা নির্বাসনে থাকবে যক্ষ- এটাই তার শাস্তি। এর মধ্যে দশ মাস অতিবাহিত হয়ে গেছে, মাত্র দুটি মাস বাকি, তার পরেই সে ফিরে যেতে পারবে রাজধানী অলকাপুরীতে। কিন্তু এরই মধ্যে এসে গেল আষাঢ় মাস। বর্ষা কাল। মেষের সে কী নয়ন-ভোলানো মনমাতানো রূপ! সমস্ত পর্বত অরণ্যানী নতুন সাজে সেজে উঠেছে যেন। দশটা মাস তার কোনো কষ্ট হয়নি, হঠাৎ এখন বাড়ির জন্য এমন মন কেমন করতে লাগল যক্ষের যে সে যেন পাগল হয়ে যায়। নববধূর জন্য কষ্ট হতে লাগল, শহুরে জীবনের আমোদ-আহ্লাদের জন্য শোক উথলে উঠল। তার ভয় হয়, বেচারি অভাগিনী বৌটি বেঁচে আছে তো। যক্ষ বেঁচে নেই ভেবে সে- যদি দুঃখ-শোকে মরে গিয়ে থাকে! সেকালে তো আর ডাকব্যবস্থা ছিল না যে যক্ষ স্ত্রীকে চিঠিপত্র লিখবে। কী করে এখন! হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে যায়। আচ্ছা, মেঘ তো উড়ে উড়ে দেশ-দেশান্তরে যায়; যদি মেঘকে অনুনয়-বিনয় করে বলি যে, 'ভাই মেঘ, তুমি আমার খবরটা আমার স্ত্রীকে একটু পৌঁছে দিয়ে এস', তো সে যাবে না? এটাই হলো 'মেঘদূতম্' কাব্যের কাহিনী। পূর্বমেঘ জুড়ে মেঘকে বর্ণনা দিচ্ছে যক্ষ- কীভাবে কোন পথ দিয়ে মেঘ অলকাপুরীতে যাবে। আর উত্তরমেঘে যক্ষ বুঝিয়ে দিচ্ছে মেঘকে- রাজধানী অলকায় অত ঘরবাড়ি রাস্তাঘাটের ভেতরে মেঘ কী করে চিনে নেবে যক্ষপ্রিয়াকে, তার হদিস। মেঘকে দূত হিসাবে পাঠানো হয়েছে বলেই কাব্যটির নাম মেঘদূত। কালিদাস শুধু কবিতা বা নাটকের কারণেই আজকের দিনে গুরুত্বপূর্ণ নন। তার লেখালেখিতে রয়েছে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস, ভূগোল রাজনৈতিক নানা উপাদান। তিনি আজও আমাদের অনুপ্রেরণার কারণ। ১৯৬৬ সালে তাকে নিয়েমহাকবি কালিদাসনামে একটি তামিল সিনেমাও নির্মিত হয়েছে। তাকে নিয়ে হয়ত গবেষণা চলতে থাকবে আরও দীর্ঘকাল

 

 কালিদাসকে স্মরণীয় করে রাখতে তার নাটক অবলম্বনে নির্মিত ডাকটিকিট;

সূত্রসমূহ ১। কালিদাসের মেঘদূত, অনুবাদক বুদ্ধদেব বসু, বোধি প্রেস, কলকাতা, সেপ্টেমবর ১৯৫৭ ২। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দশ সাহিত্যিক, হায়াৎ মামুদ, সাহিত্য প্রকাশ, নভেম্বর ২০০৭

Post a Comment

0 Comments

Update Posts

স্মার্ট নাগরিক গঠনে গ্রন্থাগারের ভুমিকা রচনা ১০০০ শব্দ
তালিবানি মুখোশ খুলে ঝাঁঝরা হয়েছিলেন সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায় লাভ জেহাদীর, মাধ্যমে ধর্মান্তরিত হয়ে নির্যাতিত হয়েছে ধর্ষিত হয়েছে মারা গেছে এরকম দশটি কাহিনী
Disclaimer
১০টি বাংলাদেশের সেরা ক্যান্সার হাসপাতাল  10 best cancer hospitals in Ban...
১০ বছরে মাধ্যমিক, ১৬-তে ইঞ্জিনিয়ার, ক্যাটও পাশ করে ফেলল এই কিশোরী!
Top 14 Best Paying CPC/PPC Ad Networks
100% Proof - How to Get Back Suspended YouTube Channel Bangla - 100% Solution
Keyboard shortcuts for Windows
ইবনে সিনা হাসপাতালের ডাক্তার লিস্ট | Ibn Sina Hospital Dhanmondi Doctor ...
Goutom buddho biography গৌতম বুদ্ধের জীবনী গৌতম বুদ্ধের জীবনের বিস্ময়কর অজানা তথ্য  ইতিহাস জেনে নিন