সাধক পুরুষ লালন সাঁইয়ের জানা অজানা জীবনী Lalon biography

Lalon biography

 'মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি' - এই লাইনটি বাউল সম্রাট লালন সাঁইয়ের। তিনি মানুষের ভেতরের মানুষকে বাঁচানোর জন্য জীবনভর যুদ্ধ করে গিয়েছেন।  ১৭৭৪ সালে তিনি কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার চাপড়া ইউনিয়নের ভাড়ারা গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। কুষ্টিয়া তখন জেলা ছিল না, অবিভক্ত ভারতবর্ষে নদীয়া জেলার অন্তর্গত মহকুমা ছিল। কুমারখালী ছিল তখন ইউনিয়ন। লালন গড়াই নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা ভাড়ারা গ্রামের হিন্দু পরিবারে জন্ম গ্রহন করেন। তাঁর বাবা ছিলেন শ্রী মাধব কর আর মা ছিলেন শ্রীমতি পদ্মাবতী।

 

আমরা বরাবরই ভুলে যাই ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে আমরা মানুষ। আমাদের এই ভুলে যাওয়ার ফলাফল আজ আমরা বিশ্বব্যাপী দেখতে পাচ্ছি।  দেশে দেশে যুদ্ধ, নিজের দেশের নাগরিকদের ওপর অত্যাচার সবই হচ্ছে ধর্মের নামে। কিছু মানুষ নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। আজ থেকে ২৪৩ বছর আগে লালনও মুখোমুখী হয়েছিলেন অসুস্থ সমাজ আর ধর্মব্যবসায়ীদের।

লালন শৈশবেই তার বাবাকে হারান। মায়ের আদর স্নেহে বেড়ে উঠেন তিনি। পরিবারের প্রধান বেঁচে না থাকায় লালন সংসারের হাল ধরেন। মায়ের দেখাশুনা করার জন্য লালন বিয়ে করেন। লালন খুব নীতিবান ছিলেন। তার প্রমান হলো আত্মীয় স্বজনদের সাথে তাঁর বনিবনা না হওয়ায় মা ও স্ত্রীকে নিয়ে একই গ্রামের দাসপাড়ায় নতুন করে বসতি গড়েন। তিনি শৈশব থেকেই  সংসারের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন, ফলে পড়াশোনা করতে পারেন নি। তবে গানের প্রতি তার অন্যরকম টান ছিলো। ভাড়ারা গ্রামে কবিগান,পালাগান,কীর্তন সহ নানা রকম গানের আসর বসতো। তিনি সেই আসর মাতানোর একজন ছিলেন। মানুষ মুগ্ধ হয়ে তার গান শুনতো।

লালন পূন্যলাভের আশায় যৌবনের শুরুতে ভাড়ারা গ্রামের দাসপাড়ার প্রতিবেশী বাউলদাস সহ অন্যান্য সঙ্গী-সাথী নিয়ে মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরে গঙ্গা স্নানে যান। সে সময় রাস্তা ঘাটের অবস্থা খুব খারাপ ছিলো। সে সময় মানুষের একমাত্র পরিবহন ছিলো তাদের পা।  পায়ে হেঁটেই মানুষ দূর -দূরান্তে যেতেন। কিছু কিছু ধনী পরিবারের জন্য ঘোড়া এবং গরুর গাড়ির প্রচলন ছিলো। তাও সংখ্যায় খুবই কম। গঙ্গা স্নান সেরে লালন যখন সঙ্গীদের সাথে বাড়ি ফিরছিলেন, তখন তিনি আকস্মিকভাবে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হন। রোগের যন্ত্রনা সহ্য করতে না পেরে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। সঙ্গীরা মনে করলেন তিনি মারা গেছেন।  তারা তার মুখাগ্নি করেই  নদীর জলে ভাসিয়ে দেয়। সঙ্গীরা তার মা এবং বউকে তার মৃত্যুর খবর দেন। অদৃষ্টের করুণ পরিহাস মনে করে তার মা এবং বউ তার মৃত্যু মেনে নেন এবং ধর্মমতে সমাজকে নিয়েই তার অন্ত্যষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করেন।

অন্যদিকে নদীতে ভাসতে ভাসতে লালনের দেহ এক ঘাটে পৌঁছায়। এক মহিলা নদীতে পানি আনতে যেয়ে দেখেন একজন জীবন্ত মানুষ পানিতে ভাসছে। তাঁর চোখের পাতা পড়ছে,হাত-পা নড়ছে দেখে মহিলা তাকে বাড়িতে নিয়ে আসে। মহিলা এক মুসলিম পরিবারের রমণী ছিলেন। মহিলার সেবা শশ্রুষা পেয়ে লালন সুস্থ্য হয়ে ওঠেন। বসন্ত রোগে লালনের একটি চোখ নষ্ট হয়ে যায় এবং মুখাগ্নির কারণে তার মুখমন্ডলে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়। সুস্থ্য হয়ে লালন ফিরেন মায়ের কোলে, নিজ গ্রামে।

পুত্রের ফিরে আসায় মা আনন্দে আত্মহারা আর স্বামীর ফিরে আসায় স্ত্রী কৃতজ্ঞতা জানায় সৃষ্টিকর্তাকে। মৃত মানুষ ফিরে এসেছে এই খবর শুনে আশেপাশের মানুষজন লালনকে দেখতে আসে। সমাজপতিরাও আসেন লালনকে দেখতে। তবে যতটা না দেখতে তার থেকে বেশি তাদের নিয়মনীতি দেখতে।  সমাজপতিদের সাফ কথা লালনের অন্তুষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে এবং সে মুসলমান বাড়ির জল খেয়েছে তাই তাঁকে আর এই সমাজে থাকতে দেয়া যাবে না। সেদিন ধর্মের অজুহাতে লালনকে সমাজ থেকে বের করে দেয়া হয়। বিচ্যুত করা হয় মা ও স্ত্রীর কাছ থেকেও। লালনের স্ত্রী লালনের সাথে গৃহত্যাগী হতে চেয়েছিলেন কিন্তু সমাজের শাসন,লোকচক্ষুর ভয়,ধর্মের বেড়াজাল তার সে পায়ে শিকল পরিয়ে দেয়। এই দু:খ যন্ত্রনা সইতে না পেরে লালনের স্ত্রী কিছুদিনের মধ্যেই মৃত্যুবরণ  করেন ।

ধর্মের অজুহাতে সমাজপতিরা তাঁকে সমাজ থেকে বিচ্যুত করে এই মর্মবেদনা লালনকে দারুনভাবে পীড়া দেয়। মূলত: এখান থেকেই তার ভাবনার বিকাশ ঘটে। সমাজ বিচ্যুত লালন মরমী সাধক সিরাজ সাঁইয়ের সাথে যোগাযোগ ঘটে । সিরাজ সাঁই ছিলেন কাহার সম্প্রদায়ের একজন সাধক পুরুষ। এই সাধকের সান্নিধ্যে এসে লালন দিনে দিনে হয়ে উঠেন আধ্যাত্বিক চিন্তা চেতনার পুরুষ। সিরাজ সাঁইকে গুরু হিসেবে গ্রহন করে লালন হয়ে উঠেন ফকীর লালন সাঁই । ফকীর লালন ছিলেন গুরুবাদে বিশ্বাসী।

লালন বিশ্বাস করতেন গুরু ঈশ্বরেরই প্রতিচ্ছায়া। গুরুকে ভক্তি শ্রদ্ধা করলে তা ঈশ্বরই পাবেন। গুরু ছাড়া কোনো সাধনায় সাধ্য হবে না। গুরু সিরাজ সাঁই এর নির্দেশে লালন কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার ছেঁউড়িয়া গ্রামে আখড়া করেন। প্রথম দিকে লালন ছেউড়িয়া গ্রামের কালীগাঙের পাড়ে গহীন বনের মধ্যে একটি আম গাছের নীচে বসে ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। ধ্যান মগ্ন লালন কখনও জঙ্গল থেকে বের হতেন না। তিনি জঙ্গলের মধ্যেই আনমেল নামের এক প্রকার কচু খেয়ে থাকতেন। জঙ্গলে এক সাধক পুরুষ আছে এই কথা এক কান দুই কান হতে হতে আশেপাশে ছড়িয়ে যায়।

ছেঁউড়িয়া গ্রামটি ছিল কারিকর সম্প্রদায় প্রধান গ্রাম। সাঁইজীর অনুমতি নিয়েই কারিকর সমপ্রদায় লালনের একটি আখড়া বাড়ি তৈরী করে দেয় এবং সবাই তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহন করে । লালনের প্রথম পর্যায়ের শিষ্যত্ব গ্রহন করে ছেউড়িয়ার এই কারিকররাই। লালন প্রথমদিকে আখড়ায় খুব কমই থাকতেন। শিষ্যদের নিয়ে তিনি পার্শ্ববর্তি অঞ্চল পাবনা,রাজশাহী,যশোর,ফরিদপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় তাঁর মতবাদ গানের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেন। এই সময় তাঁর গানের জ্ঞান ছড়িয়ে পড়ে। সাধারন মানুষ সে হোক হিন্দু কিংবা মুসলিম সবাই তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহন করতে থাকে। কারন লালনের গানের মধ্যে তারা মানবমুক্তির ঠিকানা খুঁজে পায়। জাত-পাতহীন.ধর্ম-বর্নহীন সমাজের কথাই ছিল লালনের গানের মূল কথা।

লালনকে সমাজ থেকে বিচ্যুত করা এবং তার স্ত্রির মৃত্যুর পর তার অসহায় মা ভেকশ্রিতা হয়ে ভাড়ারা গ্রামের বৈরাগী কুম্ভ মিত্রের আখড়ায় আশ্রয় নেন এবং জীবনের বাকি সময়টা এখানেই কাটিয়ে দেন। লালন মায়ের মৃত্যুর খবর শুনার পর মায়ের শেষ কৃত্যানুষ্ঠানের সব কিছু পাঠিয়ে দেন। খাবার দাবার থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র। আধ্যাত্মিক জীবনের মধ্যেও বুকের পাঁজরে লুকিয়ে রেখেছিলেন তাঁর মাকে।

যে জাতের কারণে লালনকে সমাজ থেকে, পরিবার থেকে বিচ্যুত করা হয়েছিলো, সেই জাত-পাতের বিরুদ্ধে লালন গানের মাধ্যমে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। তিনি তাঁর গানে উল্লেখ করেছেন-

 

" জাত না গেলে পাইনে হরি

কি ছার জাতের গৌরব করি

ছুঁসনে বলিয়ে।

লালন কয় জাত হাতে পেলে

পুড়াতাম আগুন দিয়ে ॥ "

মধ্যযুগীয় কুসংস্কার আর ধর্মীয় গোঁড়ামীর সেই অন্ধকারের সময়ে জাত-কুলই প্রধান বিষয় ছিল। লালন  মাঠে-ঘাটে, পথে-প্রান্তরে জাত-পাত,ধর্মীয় গোড়ামীর উর্ধ্বে উঠে মানুষের ভেতরের মানুষকে জাগানোর জন্য গান গেয়েছেন। মানবতাবাদী মতাদর্শ প্রদর্শন এবং প্রচার করার কারণে লালনের শিষ্যরা নানা রকম বিপদের মুখে পড়েছেন। হিন্দু ও মুসলমান দুই ধর্মেরই উঁচু জাতের সমাজপতিরা তাদের বিপক্ষ অবস্থান নেয়। বিভিন্ন জায়গায় তারা বাউলদের মাথার চুল কেটে,হাতের একতারা ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়েছে । তবুও বাউলরা তাদের আদর্শ থেকে পিছিয়ে যায়নি। বিশেষ করে লালনের মৃত্যুর পর বাউল নির্যাতনের সংখ্যা বেড়ে যায়। বাউল শীতল শাহ্‌ ও ভোলাই শাহ্‌’র মৃত্যুর পর এর সংখ্যা আরও বেড়ে যায়।

লালনের আখড়া বাড়ির জন্য তার এক ভক্ত মলম শাহ্‌ কারিকর ১৬ বিঘা জমি দেন। ১৯৪৫সালের ১১ ডিসেম্বর এই আখড়া বাড়িটি নিলামে উঠে যায়। তারপর লালনের অন্য এক ভক্ত ইসমাইল শাহ ১’শ সাত টাকায় চার আনায় উক্ত আখড়াবাড়ি লালনের নামে খরিদ করে তা রক্ষা করেন। যুগে যুগে লালন ভক্তরা তাদের সাঁইজীর আদর্শ স্মৃতিচিহ্ন রক্ষার জন্য সাহসী ভুমিকা পালন করেছেন।

লালনের ধর্ম নিয়ে আছে নানা জল্পনা কল্পনা।  মুসলমানরা দাবী করেন লালন মুসলিমের, হিন্দুরা দাবি করেন তিনি হিন্দুদের। লালন গবেষকদের ধারনা লালন যখন সিরাজ সাঁই এর সান্নিধ্যে আসেন তখন ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে থাকতে পারেন। তবে এ বিষয়ে লালন তাঁর গানের মাধ্যমে নিজের ধর্মীয় অবস্থান পরিস্কার করে  গেছেন। তিনি বলেছেন-

" সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে

লালন বলে জেতের কি রুপ দেখলাম না এ নজরে ॥ "

লালন তার ধর্মের অবস্থান আরো পরিষ্কার করে গেছেন তাঁর মৃত্যুপরবর্তি আচার আচরণ এর মাধ্যমে।  তিনি জীবদ্দশায় বলে গেছেন তাঁর মৃত্যুর  পর যেন কোন ধর্মীয় শাস্ত্র অনুযায়ী দাফন না  করা হয়। জানাযা কিংবা শ্মশানে হরির কীর্তন কোনটিই না করার নির্দেশনা দিয়ে যান। তিনি বলে যান তিনি যে ঘরে বসেন সেখানে যেন দাফন করা হয়। এই মাজারকে ঘিরেই বর্তমানে  বাউল উৎসব হয়। কোন ধর্মীয় শাস্ত্র ছাড়াই লালনকে দাফন করা হয়। লালন কোন ধর্মের অনুসারী ছিলেন না। তবে সব ধর্মের মানুষের সাথে তাঁর ছিল ভাল সম্পর্ক। সকল ধর্মের মানুষ তাঁকে আপন বলে জানতো, যার কারনে সকল ধর্মের  মানুষই লালনকে তাদের ধর্মের ভেবেছে।

লালন সাঁই গানের মাধ্যমে সমাজের জাতিভেদ,উচু-নীচু,ধর্মীয় গোঁড়ামী,স্যুঁৎ প্রথার বিরুদ্ধে মানুষের চেতনা ফিরিয়ে আনেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের পক্ষে মানুষের বিবেককে জাগিয়েছেন । মানুষের ভিতরের পশুকে হত্যা করে মানবতার জয়গান গেয়েছেন। লালনের প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা ছিলো না, তার ছিলো বিবেকের শিক্ষা।  তিনি তার বিবেকের পাঠশালা থেকে যে শিক্ষা নিয়েছিলেন তা আজও বিশ্বব্রম্মান্ডে চলছে গবেষনার পর গবেষণা। তাঁর পান্ডিত্য, জ্ঞানের গভীরতা আজ মানব জাতির কল্যানে ব্যবহার হচ্ছে। লালন তার প্রতিটা কথার জবাব গানের মাধ্যমে দিতেন। আকস্মিকভাবে তাঁর হৃদয় থেকে উৎসারিত সে গান আর সুর মানুষের অন্তরকে বিকশিত করতো।

লালনের মনে যখন কোন ভাবের উদয় হতো তখন তিনি ‘পোনা মাছের ঝাক’ বলে সংকেত দিতেন।  এই সংকেত শোনার পর তার শিষ্যরা দৌড়ে আসতো একতারা আর ডুগডুগি হাতে। মানিক শাহ পন্ডিত ও মনিরুদ্দিন শাহ খাতা কলম নিয়ে ছুটে আসতেন। লালনের ভক্তরা দাবী করে সাঁইজীর ১০হাজারের মত গান রয়েছে তবে গবেষকদের ধারনা তা হবে এক হাজারের মত। লালনের গান তাঁর কন্ঠ থেকে শিষ্যদের মাধ্যমে গনমানুষের কন্ঠে ছড়িয়ে পড়ে। যে গান এখন বাংলার সবখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।

পৃথিবীতে সব সাধক পন্ডিৎ ব্যক্তিরা সেছেন মানুষের কল্যানে, সমাজের কল্যানে। তারা কখনো নিজেদের নিয়ে ভাবেন নি। তারা  মানুষের মুক্তির  পথ  খুঁজেছেন, দেখিয়েছেন আলোর পথ। লালনের গান দেহকেন্দ্রীক। গ্রামের মানুষেরা এই গানকে দেহতত্ব বলে থাকে। লালন বিশ্বাস করতেন এই মানব দেহের মধ্যেই সব আছে। এই দেহের মধ্যেই ভাবের মানুষ, মনের মানুষ, অচিন পাখি বাস করে। লালন মানবদেহকে কখনও ‘ঘর’ কখনও ‘খাঁচা’ আবার কখনও ‘আরশীনগর’ নামে ডেকেছেন।এ বিষয়ে তাঁর গানে উল্লেখ রয়েছে –

 

"আমার ঘরখানায় কে বিরাজ করে

তাকে জনম-ভর একদিন দেখলাম নারে…"

বাউল সম্রাট লালন কোন ধর্মকে অস্বীকার না করলেও প্রচলিত ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিক রীতিনীতির বিরুদ্ধে ছিলেন। শাস্ত্রীয় ধর্মের  দেয়াল ভেঙ্গে তিনি খুঁজে পান মানব ধর্মের  এক বিশাল শষ্যক্ষেত্র। লালন প্রচলিত হিন্দু ধর্মেও যাঁতাকলে পিষ্ট হয়েছেন। লালন নিজেকে দিয়েই উপলব্ধি করেছেন ধর্ম মানুষকে কিভাবে শোষণ করে, শাসন কেও এবং সমাজপতিরা কিভাবে নিজেদেও স্বার্থে ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। ধর্ম হাতিয়ার নয় ধর্ম হবে মানবমুক্তির পথ। তিনি এক নির্ভৃত পল্লীতে বসে সমাজ সংস্কারে নিজেকে জড়িয়েছিলেন অত্যান্ত শক্তভাবে।

Read More: বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনী

লালন জন্মের সতের বছর আগে পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজ বাহিনীর কাছে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতন হয়। হারিয়ে যায় বাংলার স্বাধীনতা। দেশে শুরু হয় বৃটিশ বেনিয়াদের  জুলুম অত্যাচার নির্যাতন। সে সময় ভূমি ব্যবস্থারও পরিবর্তন ঘটে। শুরু হয় নতুন সামন্ত শ্রেনীর। অবশ্য লালনের সময়েই ইংরেজ শাসকদের অত্যাচার নির্যাতনের বিরুদ্ধে শুরু হয় তিতুমীরের সংগ্রাম, সিপাহী বিদ্রোহ, ওহাবি-ফারায়জী আন্দোলন, নীল বিদ্রোহসহ বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষক বিদ্রোহ।

হিন্দু মেলা, জাতীয় কংগ্রেস গঠনের মাধ্যমে গণজাগরনের কাজ শুরু হয়। রামমোহনের ব্রাম্মধর্ম প্রবর্তন, বিদ্যাসাগরের সংস্কার কার্যক্রমও শুরু হয় এই সময়ে। কোলকাতা কেন্দ্রীক ‘বাবু কালচারের’ বাইেও প্রত্যান্ত গ্রামের এক জঙ্গলে বসে একতারার সুরে বাউল গানের আলো ছড়িয়ে দিয়েছিলেন লালন।  মৃত্যুকালে লালন দশ হাজারের মত শিষ্য-ভক্ত রেখে গেলেও কালের বিবর্তনে আজ সারা বিশ্বজুড়ে তাঁর লক্ষ কোটি অনুসারী,ভক্ত যা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। মানবতাবাদ আজকের আধুনিক বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মতবাদ যা লালন যুগে যুগে ধারন এবং বাহন করেছেন। গানের মাধ্যমে সব মানুষের কাছে তাঁর বাণী পৌঁছে দিয়েছেন ।

লালন মনে করেছেন ধর্ম হলো তাই যা ধারন করা হয়। বাউল মন যা ধারন করে তাই- ই বাউলের ধর্ম। মানব আত্মার মুক্তির জন্য তাদের জীবনভর যে সংগ্রাম তা কখনই সহজ ছিল না। হিন্দু-মুসলিম উভয় ধর্মেরই যারা সমাজকে শাসন করেছে, সমাজের মানুষকে ধর্মেও চাবুকে নিজেদের আঘাত করেছে তারা সবাই লালনকে নাড়ার ফকির, অশিক্ষিত, মুখ্য বলে অপবাদ দিয়েছে। সেই সাথে অপপ্রচার করেছে তাঁর অনুসারীদের বিরুদ্ধে। খেটে খাওয়া পিছিয়ে পড়া মানুষেরা লালনের গান শুনে তাঁদের জীবনের সন্ধান পেয়েছে। খুঁজে পেয়েছে আত্মার শান্তি। দেশপ্রেম, মানবপ্রেম কি নেই লালনের গানে। হৃদয়ের তানপুরা বেজে উঠে বাউল গানে।

যুগে যুগে গান এসেছে মানুষের বিনোদনের খোরাক হয়ে। কিন্তু লালনের গান এসেছে জ্ঞানের আলো ছড়াতে। মানুষের অন্তরকে  বিকশিত করতে। লালনের গান মানুষকে করেছে মানবতাবাদী, হৃদয়কে করেছে আকাশের মত উদার আর সাগরের মত গভীর। মানুষকে মানুষ ভাবতে শিখিয়েছে। মানুষকে সেবা করলে স্রষ্টাকেই সেবা করা হয়। সষ্টার সৃষ্টিকে ভালবাসলে পক্ষান্তরে স্রষ্টাকেই ভালবাসা হয় এ কথা প্রথম লালন সাঁই তাঁর গানের মধ্য দিয়েই বলে গেছেন। লালনের বাউল জীবনের পেছনে রয়েছে ধর্ম জিজ্ঞাসা,আধ্যাত্মিক জ্ঞান বিকাশের পাশাপাশি সেই অন্ধকার যুগের ধর্মীয় গোঁড়ামী, ধর্ম ব্যবসায়ীদের স্বেচ্ছাচারী আচরন ও জাতিভেদেও মত পীড়াদায়ক ও বেদনা বিধূর ঘটনার অভিজ্ঞতা।

যৌবনের শুরুতে এক শ্রেনীর সুবিধাবাদী মানুষের কাছে দারুন লাঞ্চনার শিকার হয়ে সমাজচ্যুত হলেও পরবর্তি সময়ে তিনি মানুষের ভালবাসা পেয়েছেন প্রচুর। তিনি কখনও মানুষকে অবজ্ঞা কিংবা অবহেলা করেননি। মানুষ হিসেবে মানুষের প্রতি তাঁর এই টান তাঁকে ঐশ্বরিক টানের কাছে নিয়ে গেছে। যার কারনে তিনিু মানুষের মাঝেই ঈশ্বর খুঁজেছেন। যে সময় জাতিভেদ এবং ছুঁৎ মার্গ সমাজে প্রবল আকার ধারন করেছে সে সময় লালন সংগ্রাম বহু সংগ্রাম কেও এই শক্ত দেয়াল ভেঙ্গেছেন। সমাজবিজ্ঞানীরা লালনকে বাংলার নবজাগরনের পথিকৃত রামমোহনের সাথে তুলনা করেছেন।‘বাংলার নবজাগরণে রামমোহনের যে গুরুত্ব বাংলার লোকমানসের দেয়ালী উৎসবে লালনেরও সেই গুরুত্ব। দুই যমজ সন্তানের মতো তাঁদের দু’জনের জন্ম। দু’বছর আগে পরে । ইতিহাস-জননীর পক্ষে দুই বছর যেন দুই মিনিট। তবে এক সঙ্গে এলেও তাঁরা এক সঙ্গে যাননি। লালনের পরমায়ু যেন রাম মোহন ও বঙ্কিমচন্দ্রের জোড়া পরমায়ু। লোক সংস্কৃতিতে একক ব্যক্তিত্বেও এমন বিরাট উপস্থিতি আমাদের অভিভূত করে।

বাউল সম্রাট লালন সাঁই কারো বিপদ দেখলে বসে থাকতে পারতেন না । তিনি একদিন খবর পেলেন কাঙাল হরিনাথের উপর হামলার জন্য জমিদারের লাঠিয়াল বাহিনী ধেয়ে আসছে। এই খবর পেয়ে লালন তাঁর শিষ্যদেও নিয়ে পাল্টা লাঠি হাতে জমিদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এতে জমিদারের লাঠিয়াল বাহিনী পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। কাঙাল হরিনাথ ছিলেন সেই সময় কুমারখালী থেকে প্রকাশিত “গ্রামবার্ত্তা পত্রিকা’র” সম্পাদক। তাঁর অপরাধ ছিল তিনি জমিদারদের  অত্যাচার নির্যাতন আর জুলুমের কথা ঐ পত্রিকায় প্রকাশ করেছিল।  সৎ পথে,সৎ কাজে তিনি ছিলেন অবিচল । যা তাঁর গানের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন-

' সত্য বল সুপথে চল

ওরে আমার মন॥ '

লালন সাঁই এর সাথে কুমারখালী থেকে প্রকাশিত এদেশে বাংলা সংবাদপত্রের পথিকৃৎ কাঙাল হরিনাথের সাথে বেশ ঘনিষ্ঠতা ছিল। কাঙালের মাধ্যমে সম্পর্ক গড়ে উঠে বিষাদসিন্ধুর লেখক কথাসাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেনের সাথে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথেও তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছে বলে অধিকাংশ গবেষক লিখেছেন। তবে নির্ভরযোগ্য অনেক সুত্র বলে কবিগুরুর সাথে দেখা হয়নি। দেখা হয়েছিল কবিগুরুর বড় দাদার সাথে।

লালন সাধু দরবেশ হওয়া সত্বেও সংসারের প্রতি তার দারুন টান ছিল। এক মুসলিম মহিলা বয়ানকারীনিকে বিবাহ করেন এবং ভক্তদের  দেওয়া জায়গায় পানের বরজ করেন সংসার চালানোর জন্য। এছাড়াও তিনি মৃত্যুর আগে তাঁর পালিত কন্যা পিয়ারীর সাথে ভোলাই শাহ্‌’র বিবাহ দেন।

১৮৯০সালের ১৭ অক্টোবর (১২৯৭ সালের ১ কার্তিক) শুক্রবার ভোর সাড়ে ৫টায় ১১৬ বছর বয়সে বাঙলা আর বাঙালীর হৃদয়ের মানুষ বাউল সম্রাট মরমী সাধক লালন শাহ্‌ ইন্তেকাল ত্যাগ করেন। যেদিন ভোরে তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছেন ঐ দিনও সারারাত ধরে আখড়ায় বাউল গান নিয়ে শিষ্য ভক্তদের সময় দিয়েছেন। ভোর ৫টায় তিনি সকল ভক্তদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন “আমি চলিলাম”। এই কথার আধা ঘন্টা পর তিনি সকলকে কাঁদিয়ে সত্যি সত্যিই একেবারে চলে যান।

Read More: হ্যাল এলরড 10টি বানী হ্যাল এলরড 10টি বানী

 

 

আরও পড়ুনStephen Hawking Biography

উপসংহার

বন্ধুরা, এই পোস্টে আমরা আপনাকে লালন শাহ Lalon  সম্পর্কে বলেছি। আশা করি আপনি এই পোস্টটি পছন্দ করবেন।

আপনার এই পোস্টটি কেমন লেগেছে, মন্তব্য করে আমাদের জানান এবং এই পোস্টে কোনও ত্রুটি থাকলেও আমরা অবশ্যই এটি সংশোধন করে আপডেট করব।

 

লালন শাহ Lalon biography  Biography, Famous Quotes ও উক্তি সমূহ লেখাটি ভালো লেগে থাকলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করো। এই ধরনের লেখার নিয়মিত আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজটি ফলো ।

 

ডেইলি নিউজ টাইমস বিডি ডটকম (Dailynewstimesbd.com)এর ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব ও ফেসবুক পেইজটি ফলো করুন করুন।

উক্ত আর্টিকেলের উক্তি ও বাণীসমূগ বিভিন্ন ব্লগ, উইকিপিডিয়া এবং Narendra modi রচিত গ্রন্থ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।

 

তথ্যসূত্র: Wikipedia, Online

ছবিঃ ইন্টারনেট

দৃষ্টি আকর্ষণ এই সাইটে সাধারণত আমরা নিজস্ব কোনো খবর তৈরী করি না.. আমরা বিভিন্ন নিউজ সাইট থেকে খবরগুলো সংশ্লিষ্ট সূত্রসহ প্রকাশ করে থাকি.. তাই কোনো খবর নিয়ে আপত্তি বা অভিযোগ থাকলে সংশ্লিষ্ট নিউজ সাইটের কতৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করার অনুরোধ রইলো। ধন্যবাদ সবাইকে।

 

Post a Comment

0 Comments

Update Posts

স্মার্ট নাগরিক গঠনে গ্রন্থাগারের ভুমিকা রচনা ১০০০ শব্দ
তালিবানি মুখোশ খুলে ঝাঁঝরা হয়েছিলেন সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায় লাভ জেহাদীর, মাধ্যমে ধর্মান্তরিত হয়ে নির্যাতিত হয়েছে ধর্ষিত হয়েছে মারা গেছে এরকম দশটি কাহিনী
Disclaimer
১০টি বাংলাদেশের সেরা ক্যান্সার হাসপাতাল  10 best cancer hospitals in Ban...
১০ বছরে মাধ্যমিক, ১৬-তে ইঞ্জিনিয়ার, ক্যাটও পাশ করে ফেলল এই কিশোরী!
Top 14 Best Paying CPC/PPC Ad Networks
100% Proof - How to Get Back Suspended YouTube Channel Bangla - 100% Solution
Keyboard shortcuts for Windows
ইবনে সিনা হাসপাতালের ডাক্তার লিস্ট | Ibn Sina Hospital Dhanmondi Doctor ...
Goutom buddho biography গৌতম বুদ্ধের জীবনী গৌতম বুদ্ধের জীবনের বিস্ময়কর অজানা তথ্য  ইতিহাস জেনে নিন