#জীবনখাতার প্রতিপাতায় সেদিন বাইরের ঝড় যেন আমার মনেও তুফান তুলেছিল।

 

#জীবনখাতার প্রতিপাতায়  সেদিন বাইরের ঝড় যেন আমার মনেও তুফান তুলেছিল।

সেদিন বাইরের ঝড় যেন আমার মনেও তুফান তুলেছিল। খুব ঝড়বৃষ্টি হচ্ছিল বলে আমায় টিউশন থেকে নিতে এসেছিল বাবা। রিকশায় উঠিয়ে বলেছিল "কাল থেকে আর টিউশনে আসার দরকার নেই। তোমার বিয়ের বন্দোবস্ত করা হচ্ছে। বাড়িতে থেকে বরং মায়ের কাছে রান্নাবান্না শেখো।" আকাশ থেকে পড়লাম আমি। বললাম পড়বনা মানে! গ্র্যাজুয়েশন করব না! দাদা যে এম. এস.সি করছে সেই বেলায়! বাবা বললেন "দাদা তো আয় করে আমাদের খাওয়াবে। তুমি আয় করে করবে টা কি শুনি! ভালো চাকরিওয়ালা ছেলের সাথেই তোমার বিয়ে দেওয়া হবে। সুখে শান্তিতে সংসার করবে ব্যস্।" মাথা গরম হয়ে গেল আমার। কত স্বপ্ন দেখেছিলাম পড়াশোনা শিখে চাকরি করব। বাড়িতে এসে গুম হয়ে বসেছিলাম নিজের ঘরে। কিছুক্ষণ পর মা এসে বলল "মন খারাপ করিসনা মা। মেয়েদের এত পড়াশোনা শিখে হবে টা কি! সেই তো পরের ঘরে যেতে হবে।" আমি বললাম কেন পরের ঘরে যেতে হবে! মেয়েদের নিজের ঘর থাকতে নেই! মা হেসে বলল স্বামীর ঘরই তো নিজের ঘর। পরের দিন থেকে মা উঠেপড়ে লাগল আমায় রান্না শেখানোর জন্য। কিন্তু আমার রান্নাবান্নায় মন ছিলনা। সারাদিন শুধু পড়ার বইগুলোতে হাত বুলিয়ে চোখের জল ফেলতাম।

বিয়ের সম্বন্ধ ঠিক হল তমালের সাথে। পেশায় ব্যবসায়ী। বিশাল বড় কাপড়ের ব্যবসা ওদের। তিনতলা বাড়ি গাড়ি কোনটারই অভাব নেই। আমাকে দেখতে এসে বলল কি ভালো লাগে আপনার! অসহ্য লাগছিল আমার সং সেজে ওর সামনে বসে থাকতে। আমি বললাম কিছুই ভালো লাগেনা আমার। কাজকর্মও বিশেষ কিছু জানিনা আমি। তখন ঘরে শুধুমাত্র তমাল আর আমি। তমাল হেসে বলল কিছু ভালো লাগেনা এমন তো শুনিনি কখনো! আমাদের সবারই কিছু না কিছু ভালো লাগে। আমি রেগে গিয়ে বললাম পড়াশোনা ভালো লাগে! করতে দেবেন বিয়ের পর! তমাল বলল কেন দেব না! নিশ্চয়ই দেব। তুমি যত খুশি চাও পড়তে পারো। শেখার কি কোন শেষ আছে! আমিও পড়াশোনা ভালোবাসতাম খুব। ছাত্র হিসেবে খুব একটা খারাপও ছিলাম না। কিন্তু পারলাম কই। বাবা মারা যাওয়ার পর পরিবারের ব্যবসা দেখার দায়িত্ব পড়ল আমার ওপর। গদিতে বসে লাভ ক্ষতির হিসেব করতে গিয়ে নিজের স্বপ্নগুলোকে গলা টিপে হত্যা করলাম। তবে আজো পড়াশোনা খুব ভালোবাসি আমি। কত গরীব ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার দায়িত্ব নিয়েছি আমি। ওদের মধ্য দিয়েই নিজের স্বপ্নগুলোকে বাস্তবায়িত হতে দেখি। তমালের কথা শুনে যেন হাতে আকাশের চাঁদ পেলাম আমি। ভাবলাম যাক স্বপ্নগুলো হারিয়ে যাবেনা তাহলে।খুশি হয়ে বিয়েতে মত দিলাম।
বিয়ের পর কলেজে ভর্তি হলাম। বাড়িতে কাজের লোকের অভাব না থাকায় সারাদিন পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম আমি। শাশুড়ি মা প্রথমে কিছুটা আপত্তি করলেও তমালের জেদের কাছে পরে হার মেনেছিলেন। গ্র্যাজুয়েশন করে এম.বি.এ পড়তে পড়তেই চাকরি পেলাম। দাদা বাবাকে আয় করে খাওয়াবে, বাবার এই আশায় জল ঢেলেছিল দাদা। চাকরি পেয়ে বিয়ে করে বৌ নিয়ে অন্য শহরে চলে গিয়েছিল। আমি প্রতি মাসে বাবাকে টাকা পাঠাতাম। জোর করে মায়ের হাতে টাকা গুঁজে দিয়ে বলতাম তোমার যা ইচ্ছে কিনবে। মা বলত এ বাবা! আমাকে আবার দিচ্ছিস কেন! তোর থেকে আর কত নেব! আমি বললাম কেন নেবেনা! শুধু ছেলেই দেবে! মেয়ে দিতে পারেনা! বাবা পেছন থেকে বলল আর ছেলে! এতটা কুলাঙ্গার হবে ভাবতেও পারিনি। ভাগ্যিস তুই ছিলি মা নয়ত না খেয়ে মরতে হত আমাদের। ঐ পাষন্ডটাকে মানুষ করতেই তো নিজের সর্বস্ব বাজি রেখেছিলাম। পরের বছর ছেলে হল আমার। নাম রূপ। ছোট থেকেই বলত মা আমি বড় হয়ে মস্ত বড় ডাক্তার হব। আমি ছেলের গালে আদর করে বলতাম তাই হবে বাবা। ভালোই কাটছিল দিনগুলো। কিন্তু কোথা থেকে যে একরাশ কালো মেঘ ধেয়ে আসছিল বুঝতেও পারিনি। রূপ তখন জয়েন্ট দেবে বলে প্রস্তুতি নিচ্ছিল, গাড়ি দুর্ঘটনায় তমাল চলে গেল চিরদিনের মত। যখন কেউ আমার পাশে ছিলনা তখন এই মানুষটাই আমার হাত ধরেছিল, তমাল না থাকলে হয়ত মরে বেঁচে থাকতাম সারাজীবন। সেই মানুষটাই আমায় না বলে চলে গেল চিরতরে। প্রথম কয়েকটা দিন কথা বলার মত অবস্থায় ছিলাম না আমি। তারপর মনে হল রূপের কথা! ও কি করছে! কেমন আছে! বাবার যা বাধুক ছিল ছেলেটা আমার। দৌড়ে ওর ঘরে গিয়ে দেখলাম বই খাতার ওপর মুখ গুঁজে কাঁদছে রূপ। আমি ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম ভালো ভাবে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে ডাক্তার হতে হবে তো তোকে! তোর বাবার আর আমার এটাই তো স্বপ্ন ছিল। বাড়ির বাকি আত্মীয়েরা বলল জয়েন্ট দিয়ে হবে কি! বাবার এত বড় ব্যবসা কে সামলাবে! আমি বললাম আমি আছি তো। অনেকদিন তো চাকরি করলাম এবার না হয় পরিবারের ব্যবসা দেখব। রূপকে বললাম তোর বাবা যেমন পরিবারের কথা ভেবে নিজের স্বপ্ন বিসর্জন দিয়েছিল তুই কখনো সেটা করবিনা। মন দিয়ে পড়াশোনা কর। বড় ডাক্তার হতে হবে তোকে। নিজের জীবনের লক্ষ্যে সর্বদা অবিচল থাকবি। তাহলে ভবিষ্যতে কখনো আফশোস হবেনা।
(ছবিটি কাল্পনিক )

Post a Comment

0 Comments