ডেমরায় দুই শিশু খুন ধর্ষণচেষ্টার পর হত্যা!



কোনাপাড়ায় ফারিয়া আক্তার দোলা (৫) যে স্কুলে পড়ত, নুসরাত জাহানও (৪) সোমবার সেখানে ভর্তি হয়েছিল। প্রতিবেশী এ দুই শিশু ওই দিন দুপুরে খেলতে খেলতে হারিয়ে গিয়েছিল। এরপর রাতে লাশ হয়ে ফিরেছে। দোলার জন্মদিন আজ ৯ জানুয়ারি। দরিদ্র হলেও তার মা-বাবা একমাত্র মেয়ের জন্মদিন পালন করতে চেয়েছিলেন জমকালোভাবেই। কিন্তু এর আগের দিন গতকাল মঙ্গলবার মেয়ের হত্যাকারীদের বিচার চেয়ে রাস্তায় নামতে হয়েছে পারভীন আক্তারকে। আর নুসরাতের বাসা ফাঁকা।

দুই শিশুর সন্দেহভাজন হত্যাকারী মোস্তফাকে গ্রেপ্তার ও ফাঁসির দাবি জানিয়ে গতকাল মঙ্গলবার রাস্তায় নেমেছে এলাকাবাসী। দোকানপাট বন্ধ করে তারা পালন করেছে মানববন্ধন কর্মসূচি।

সরেজমিন এলাকায় গিয়ে এক নারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ধর্ষণের চেষ্টা করায় শিশু দুটি চিৎকার করে। তখন মোস্তফা তাদের মারধর করে এবং একপর্যায়ে গলা টিপে হত্যা করে। তবে আর কোনো সূত্রে এ তথ্য নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

এলাকাবাসী জানায়, সোমবার গভীর রাতে পুলিশ সন্দেহভাজন মোস্তফাকে আটক করেছে। তবে পুলিশের তরফ থেকে এ তথ্যের সত্যতা স্বীকার করা হয়নি।

পুলিশের ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) ফরিদ উদ্দিন আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মোস্তফাকে খোঁজা হচ্ছে।’ এর বাইরে তিনি আর কোনো তথ্য দিতে চাননি।

রাজধানীর ডেমরা থানাধীন কোনাপাড়ার সামিউল আহসান রোডের ৮ নম্বর লেনের ৮ নম্বর হাবিব মঞ্জিলের নিচতলার একটি বাসায় মা-বাবার সঙ্গে থাকত শিশু দোলা। আর পাশের টিনশেড বাড়িতে মা-বাবার সঙ্গে থাকত নুসরাত। ওই এলাকার হযরত শাহজালাল রোডের ৬/এ নম্বর বাড়ির নিচতলার একটি কক্ষ থেকে সোমবার শিশু দুটির লাশ উদ্ধার করা হয়। তারা দুপুর থেকে নিখোঁজ ছিল। ওই বাসায় মোস্তফা নামের এক ব্যক্তি স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ভাড়া থাকত। ঘটনার পর মোস্তফা পালিয়ে যায়। পুলিশ তার স্ত্রী ও শ্যালককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছে।

সরেজমিনে শাহজালাল রোডের ৬/এ নম্বর পাঁচতলা বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, নিচতলায় রয়েছে দুটি ফ্ল্যাট। একটি ফ্ল্যাটের তিনটি কক্ষের একটিতে মোস্তফা তার স্ত্রী আঁখি ও ছেলে জিহাদকে নিয়ে থাকত। মোস্তফা কী করে তা কেউ নিশ্চিত করে জানাতে পারেনি। কেউ বলছিল সে রাজমিস্ত্রির কাজ করে, আবার কেউ বলছিল সে পোশাক কারখানায় চাকরি করে।

বাড়ির মালিক আবুল হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, মাসে আড়াই হাজার টাকা ভাড়ায় চার মাস আগে মোস্তফা কক্ষটি ভাড়া নেয়। তার স্ত্রী ও এক সন্তানকে নিয়ে সে বসবাস করে।

মোস্তফার কক্ষের সামনের কক্ষে থাকেন লাইলী ও তাঁর স্বামী মইনুল ইসলাম। পাশের কক্ষে থাকেন আসমা নামের এক নারী। লাইলী ও আসমার কাছে ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তাঁরা কিছুই জানেন না বলে জানান।

আসমা জানান, মোস্তফার স্ত্রী আঁখি একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। তাঁদের সাত বছরের ছেলে জিহাদ স্থানীয় একটি মাদরাসায় পড়াশোনা করে।

এলাকাবাসী জানায়, দুই শিশুকে খোঁজাখুঁজি করে মাইকিং করা হয়। তখন সন্ধ্যার দিকে এক যুবক জানান, তিনি বিকেল ৩টার দিকে মোস্তফাকে দুই শিশুকে নিয়ে তার বাসায় যেতে দেখেছেন। এরপর এলাকার লোকজন রাত ৮টার দিকে মোস্তফার বাসায় যায়। গিয়ে দেখতে পায় ঘর বাইরে থেকে আটকানো। পরে দরজা খুলে দেখে দুই শিশু খাটের নিচে পড়ে আছে।

স্থানীয় একটি সূত্রের দাবি, স্ত্রী-সন্তান বাসায় না থাকার সুযোগে খাবারের প্রলোভন দেখিয়ে দুই শিশুকে তার কক্ষে নিয়ে যায় মোস্তফা। এর পর সে এক শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা করে। তখন শিশু দুটি চিৎকার করলে প্রথমে সে তাদের মারধর পরে এবং পরে দুজনকে গলা টিপে হত্যা করে।

এক নারী কালের কণ্ঠকে বলেন, তিনি শুনেছেন যে শিশু দুটিকে হত্যার পর তাদের লাশ নিয়ে ঘরেই ছিল মোস্তফা। বিকেলের দিকে তার ছেলে জিহাদ মাদরাসা থেকে বাসায় আসে। সেও ঘরে ছিল। সন্ধ্যার পর মোস্তফার স্ত্রী আঁখি বাসায় আসেন। বাসায় ঢুকতেই দেখতে পান দরজার সামনে দুই শিশুর জুতা পড়ে আছে। আঁখি দরজায় নক করলে মোস্তফা দরজা খুলে দেয়। ভেতরে ঢুকে দুই শিশুর লাশ দেখে তিনি সন্তানকে নিয়ে বেরিয়ে যান। যাওয়ার সময় বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দেন। আঁখি পাশের বাড়িতে থাকা তাঁর ভাই হোসেনের কাছে যান। এর মধ্যে মোস্তফা দরজা খুলে দিতে ভেতর থেকে জোরে জোরে শব্দ করতে থাকে। তখন এক নারী তার ঘরের বাইরের দিকের সিটকিনি খুলে দিলে মোস্তফা পালিয়ে যায়।

দোলাদের পাশের নুসরাতদের টিনশেড বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, তার মা-বাবা কেউ বাসায় নেই। পাশের বাড়ির এক নারী জানান, নুসরাতের বাবার নাম পলাশ। মায়ের নাম তৃষা। পলাশ যাত্রাবাড়ী মাছের আড়তে কাজ করেন। সোমবার সকালে নুসরাতকে স্থানীয় একটি স্কুলে নার্সারিতে ভর্তি করা হয়। দোলাও একই স্কুলে নার্সারিতে পড়ত। তার বাবা একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন।

দুই শিশুকে হত্যার ঘটনায় ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী গতকাল সকাল ১১টার দিকে বিক্ষোভ করেছে। কোনাপাড়া বাসস্ট্যান্ড এলাকায় শত শত মানুষ মানববন্ধন করে সন্দেহভাজন মোস্তফাকে গ্রেপ্তার ও তার ফাঁসির দাবি জানায়।

মানববন্ধনে যোগ দেন দোলার মা পারভীন আক্তারও। ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বিলাপ করতে করতে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আগামী কাল (৯ জানুয়ারি) আমার মাইয়ার জন্মদিন। জন্মদিন পালনের লাইগা আমরা প্রস্তুতি নিতাছিলাম। আর এর আগেই আমার মেয়েরে মেরে ফেলল। আমি হত্যাকারীর শাস্তি চাই। তার ফাঁসি চাই।’

এ সময় পাশেই থাকা পারভীনের বোন মীমও কান্নায় ভেঙে পড়েন। দুই বোনের কান্না দেখে মানববন্ধনে আসা লোকজনের চোখ ভিজে যায়।

মানবন্ধনে যোগ দেওয়া মামুন নামের এক যুবক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা এ ঘটনা শুনে ঘরে বসে থাকতে পারিনি। আমরা হত্যাকারীর ফাঁসি চাই।’

ডেমরা থানার ওসি নূরে আলম সিদ্দিক সাংবাদিকদের বলেন, ‘খুব দ্রুত মোস্তফাকে আটক করা সম্ভব হবে বলে আশা করছি। মোস্তফার স্ত্রী ও শ্যালককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তাঁদের কাছে কোনো তথ্য আছে কি না, জানার চেষ্টা করছি।’

Post a Comment

0 Comments