বাংলার মুক্তমনাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা দের তালিকা
''আমাদের কোনো সৃষ্টিকর্তা নেই, দরকারও নেই''নাস্তিক ব্লগার আসিফ মহিউদ্দীনকে৷
ডয়চে ভেলে: কেন আপনি নাস্তিক? ধর্মকে কেন বিশ্বাস করেন না? প্রশ্ন সুবর্ণা শিকদারের৷
আসিফ মহিউদ্দীন: নাস্তিক হবার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে, আমি প্রধান ধর্মগ্রন্থগুলো সবগুলোই পড়েছি৷ পালনের জন্য নয়, জানার আগ্রহে৷ যতই পড়েছি এবং বোঝার চেষ্টা করেছি, ততই নাস্তিক হয়েছি৷ এখনো আমি সব সময় বলি, কোরান, বাইবেল, তোরাহ মাতৃভাষাতে সবাই পড়ুক৷ যত বেশি পড়বে এবং বুঝবে, নাস্তিকদের সংখ্যা তত বৃদ্ধি পাবে৷ তাছাড়া ঈশ্বরের কোনো প্রমাণও এখন পর্যন্ত কেউ দিতে পারেনি৷ যেদিন কেউ ঈশ্বরের প্রমাণ দিতে পারবে, আমার আস্তিক হয়ে যেতে আপত্তি থাকবে না৷
এই প্রশ্নের জবাবের আগে জানা প্রয়োজন, ধর্ম আসলে কী? চুম্বকের ধর্ম যেমন আকর্ষণ করা, মানুষের ধর্ম তেমনি বিশ্বমানবতা, মানুষের প্রতি প্রেম এবং ভালোবাসা৷ এরকম হলে কোনো আপত্তি ছিল না৷ কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলো মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে, পরস্পরের মধ্যে শ্রেষ্টত্বের লড়াই শুরু হয়৷ কার ঈশ্বর সত্য, কার ধর্ম সত্য এই সব কোন্দলে এই পর্যন্ত কোটি কোটি মানুষের জীবন চলে গেছে, অনেক রক্ত ঝরেছে৷ তাই প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলো মানব ধর্মের এবং মানবতার বিরুদ্ধে৷
দুই ধরনের নাস্তিক রয়েছেন, দুই দলই মনে করেন ধর্ম মানব সমাজের জন্য ক্ষতিকর৷ এদের একদল মনে করেন ধর্ম এমনিতেই ধ্বংস হয়ে যাবে সময়ের প্রয়োজনে, তার জন্য কিছু করার প্রয়োজন নেই৷ আরেক দল মনে করেন, ধর্মকে ধ্বংস করতে কাজ করতে হবে৷ আঘাত করতে হবে৷ তবে সেটা কোন শারীরিক আঘাত নয়, লেখার মাধ্যমে নিজেদের যুক্তি তুলে ধরে কোনো মতবাদ কে ভুল ও মিথ্যা তা দেখিয়ে দেয়া৷
আমাদের সৃষ্টিকর্তা কে? জানতে চেয়েছেন, জাকির হোসেন৷ আর বিজ্ঞান কি প্রমাণ করতে পেরেছে স্রষ্টা বলতে কেউ নেই? প্রশ্ন করেছেন, আকাশ মজুমদার৷
আমাদের কোনো সৃষ্টিকর্তা নেই, সেটা থাকার কোনো দরকারও নেই৷ মহাবিশ্ব পদার্থ বিজ্ঞানের সূত্রানুসারেই চলে, এখানে সৃষ্টিকর্তা বলে কিছুর প্রয়োজন নেই৷ স্টিফেন হকিং সেটা ব্যাখ্যা করেছেন তার বইতে৷
মৃত্যুর পরে মানুষের কী হয় আপনার মতে? প্রশ্ন করেছেন আকাশ রহমান৷
মৃত্যুর পরে আমাদের শরীর পচে গলে মাটিতে মিশে যায়৷ যেহেতু আমি মানে হচ্ছে, আমার মগজ, যেখানে আমার সব স্মৃতি সংরক্ষিত থাকে, আবেগ ভালোবাসা সব কিছুর কেন্দ্র যেটা, সেই মগজে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেলেই আমার অস্তিত্ব সেখানেই শেষ৷ সেই মগজ যখন মাটিতে মিশে যায়, তখন সেটা জৈব সারে পরিণত হয়৷ যেই সার কোনো গাছের বেড়ে ওঠায় কাজে লাগে৷ তাই মৃত্যুর পরে আমাদের কী হয়, সেটার সঠিক উত্তর হচ্ছে, আমরা-আমাদের শরীর প্রকৃতিতে ফিরে যাই৷
আপনি এবং আপনার মতো নাস্তিকরা শুধু ইসলাম ধর্ম বিরোধী লেখালেখি করেন কেন? ইসলামের সঙ্গে আপনাদের বিরোধ কোথায়? জানতে চেয়েছেন শিবলী নোমান৷
খ্রিষ্ট ধর্মের বয়স যখন ১৫০০ বছর ছিল, সে সময়ে সেটা ভয়াবহ মৌলবাদী এবং নিপীড়ক হয়ে উঠেছিল৷ সে সময়ে ক্রুসেডাররা পৃথিবী জুড়ে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, উইচ হান্টের নামে নারীদের পুড়িয়ে মেরেছে, বিজ্ঞানী দার্শনিক সাহিত্যিক যারাই ধর্মে অবিশ্বাস করেছে, তাদের হত্যা করেছে৷ সে সময়টাকে জ্ঞান বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অন্ধকার যুগ বলে৷
মজার ব্যাপার হচ্ছে, ইসলাম ধর্মের বয়সও এখন ঠিক ১৫০০ বছরের কাছাকাছি৷ এখন তারা বুদ্ধিজীবীদের জবাই করছে, ‘ইসলামিক স্টেট', বোকো হারাম, আল-কায়েদা সারা পৃথিবী জুড়ে জিহাদ করছে৷ ইসলামিক দেশগুলোতে ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে৷ তাই এই সময়টা ইসলামের রিফর্মেশনের৷
আমি একটি মুসলিম প্রধান দেশে জন্মেছি৷ যেমন ডকিন্স জন্মেছেন একটি খ্রিষ্টান সমাজে৷ তাকে মাঝে মাঝেই প্রশ্ন করা হয়, আপনি কেন শুধু খ্রিষ্ট ধর্মের পিছনে লেগে থাকেন? ক্রিস্টোফার হিচেন্সকেও হাজার হাজার বার জিজ্ঞেস করা হয়েছে, আপনার মত নাস্তিকেরা এত খ্রিষ্ট বিরোধী কেন?
যেসব নাস্তিক যেই সমাজে জন্মেছে, যেই ভাষায় কথা বলেছে, সেই সমাজের শক্তিশালী ধর্মটি নিয়েই বেশি আলাপ করবে৷ এটাই স্বাভাবিক৷ ভারতের নাস্তিকরা যেমন হিন্দু ধর্মের বিরুদ্ধে বেশি সোচ্চার, ইংল্যান্ডের নাস্তিকরা খ্রিষ্ট ধর্মের, তেমনি মুসলিম সমাজ থেকে আসা নাস্তিকেরা ইসলামের বিরুদ্ধে বেশি সোচ্চার৷
আসিফ মহিউদ্দীনকে প্রশ্ন করার সুযোগ শেষ হয়ে যায়নি৷ আপনার প্রশ্ন লিখুন নীচে মন্তব্যের কলামে৷
একজন সাহসী মানুষ, যাঁকে ভোলা যাবে না
ইসলামি জঙ্গিদের হাতে ব্লগার অভিজিৎ রায়ের হত্যার এক বছর পূর্ণ হচ্ছে ২৬ ফেব্রুয়ারি৷ মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রায়, ছিলেন সাহসী মানুষ, যাঁর স্মৃতি আমাদের বাঁচিয়ে রাখা উচিত বলে মনে করেন ডিডাব্লিউর গ্রেহেম লুকাস৷
মুক্তমনা হচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম ব্লগ যেখানে ধর্মনিরপেক্ষতা, নাস্তিকতা, বিজ্ঞান ও ধর্ম নিয়ে স্বাধীনভাবে লেখালেখি করা যায়৷ এটি আগে যেমন ছিল, এখনও তেমনি অনন্য এক প্রয়াস৷ মুক্ত সমাজ গঠনে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে মনে করতেন রায়৷ তাঁর বিশ্বাস ছিল, মুক্তমনা ব্লগ হবে এমন এক প্ল্যাটফর্ম যেখানে ধর্মীয় গোঁড়ামির বিষয়গুলো প্রকাশ করা হবে৷ ২০০৭ সালে এক সাক্ষাৎকারে রায় বলেছিলেন, ‘‘আমাদের লক্ষ্য এমন এক সমাজ গড়ে তোলা যেটি স্বেচ্ছাচারিতা, কুসংস্কার আর গোঁড়ামি দ্বারা নয়, পরিচালিত হবে যুক্তি, মানবতা, সমতা আর বিজ্ঞান দিয়ে৷''
রায় জন্মেছিলেন এক হিন্দু পরিবারে৷ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে এটি সংখ্যালঘুদের ধর্ম যারা এখনও বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন৷ ছাত্র অবস্থায় রায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা পড়ে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন৷ রবি ঠাকুরের লেখাই তাঁকে সত্য সন্ধানে বিজ্ঞানভিত্তিক ও যুক্তিনির্ভর তথ্যের ব্যবহার করতে শিখিয়েছে৷ পরবর্তীতে অ্যামেরিকান দার্শনিক ও নাস্তিক পল কুর্টজ দ্বারাও প্রভাবিত হয়েছিলেন তিনি৷
বাংলাদেশের অনেক মুসলমান মনে করেন, ইসলামের সমালোচনা করা ব্লাসফেমি, আর এর শাস্তি মৃত্যু৷ সে কারণে ২০০৬ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস শুরু করা রায় হত্যার হুমকি পেতে শুরু করেন৷ পরের বছরগুলোতে বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ হতে শুরু করে৷
যুদ্ধাপরাধের দায়ে ২০১৩ সাল থেকে শীর্ষ ইসলামি নেতাদের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয়া শুরু করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল৷ এর পরিণতিতে ব্লগার রাজীব হায়দারকে হত্যা করা হয়৷ তিনিও মুক্তমনা ব্লগে লিখতেন৷ ইসলামি জঙ্গিরা ইন্টারনেটে ৮৪ জন ব্লগারের একটি তালিকা প্রকাশ করে, যাদেরকে তারা হত্যা করতে চায়৷ তালিকায় অভিজিতের নামও ছিল৷ ২০১৪ সালের নির্বাচনের (কয়েকটি দল যেটি বয়কট করেছিল) মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ আবারও ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশে উত্তেজনা আরও বেড়ে যায়৷
মুক্তমনা ব্লগের অন্যতম মডারেটর ফরিদ আহমেদ ব্রিটিশ দৈনিক ‘দ্য গার্ডিয়ান'কে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, অভিজিৎ যখন ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে বৃদ্ধ মা'কে দেখার জন্য বাংলাদেশে যাওয়ার পরিকল্পনা করে তখনই তাঁকে প্রাণের হুমকির ব্যাপারে সাবধান করে দেয়া হয়েছিল৷
গ্রেহেম লুকাস, ডিডাব্লিউ-র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বিভাগের প্রধান
কিন্তু অভিজিৎ রায় শোনেননি৷ তিনি বলেছিলেন, তিনি নীরবে যাবেন৷ কিন্তু তাঁর একমাত্র ভুল ছিল তিনি বইমেলায় গিয়েছিলেন৷ ২৬ ফেব্রুয়ারি রায়ের ওপর হামলা করে ইসলামি জঙ্গিরা৷ তাঁর স্ত্রীও মারাত্মকভাবে আহত হন৷ রায় প্রাণ দিয়ে তাঁর সাহসের মূল্য দেন৷
২০১৫ সালের বাকি সময়টায় আরও তিন ব্লগার ও এক প্রকাশককে হত্যা করে ইসলামি জঙ্গিরা৷ এ ধরণের হত্যাকাণ্ড বন্ধ হবে না৷ ব্লগারদের রক্ষায় সরকার কিছু করেনি৷ বাংলাদেশে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার প্রসার এবং গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তুলতে অভিজিৎ রায় ও মুক্তমনা ব্লগের ব্লগাররা যে অবদান রেখেছেন সরকার তার স্বীকৃতি দিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না৷ হয়ত সরকার তা বিবেচনাতেই নিচ্ছেনা৷ কিন্তু একটি বিষয় স্পষ্ট, যারা বাকস্বাধীনতার সমর্থক, তাঁদের হৃদয়ে অভিজিৎ বেঁচে থাকবেন চিরদিন৷
ডেইলি নিউজ টাইমস বিডি ডটকম (Dailynewstimesbd.com)এর ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব ও ফেসবুক পেইজটি ফলো করুন করুন।
source Of DW bangla
0 Comments
Thank you for your message, I see all your messages, it is not possible to reply many times due to busyness, I hope I will reply to everyone in time, thank you for being with me. Thanks you watching my content. Please like, Follow, Subscribe.