বাংলা চলচ্চিত্র তথা বঙ্গ সংস্কৃতির কিংবদন্তি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়৷

বাংলা চলচ্চিত্র তথা বঙ্গ সংস্কৃতির কিংবদন্তি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়৷

 ইন্টারভিউয়ে প্রথম হয়েও সিনেমার চাপে অভিনেতা অনিল চ্যাটার্জি রেডিয়োয় ঘোষকের চাকরি করেন নি সেই চাকরি পেয়েছিলেন বাংলা চলচ্চিত্র তথা বঙ্গ সংস্কৃতির কিংবদন্তি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়৷

রেডিয়োয় চাকরির পরে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সিনেমায় অভিনয়ে আসার সিদ্ধান্তের প্রথম সমর্থক ছিলেন অনিল চটোপাধ্যায় ৷ দু'জনের প্রথম পরিচয় ১৯৫৭ সালে, দু'জনে সেদিন হাজির হয়েছিলেন অল ইন্ডিয়া রেডিয়োর কলকাতা কেন্দ্রে, চাকরি ঘোষকের৷ পদ কিন্তু মাত্র একটি, আবেদন করেছিলেন অনেকেই, ইন্টারভিউ দিতে এসেছিলেন একশো'র বেশি আবেদনকারী৷সেখানেই অনিল চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরিচয় হয় কিংবদন্তি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের৷প্রতীক্ষায় থাকতে-থাকতে দুজনের স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে আলাপ,পরে সেই আলাপ গভীর বন্ধুত্বে পরিণত হতে খুব বেশি সময় লাগেনি৷
অনিল চট্টোপাধ্যায় ঘোষকের চাকরির জন্য ইন্টারভিউ দিতে এসেছিলেন বটে,কিন্তু ততদিনে তিনি সিনেমার সহকারী পরিচালক,নিজের কিছু চরিত্রে অভিনয় করা হয়ে গিয়েছে৷ রেডিয়োর ইন্টারভিউয়ের দিন অনিল বললেন সৌমিত্র কে 'উল্কা'নামে একটা ছবি হতে পারে! সেখানে তিনি বড় ভূমিকায় অভিনয় করবেন সম্ভাবনা যতেষ্ট জোরালো,ছোট কিছু চরিত্রের কাজ হাতে চলে এসছে,তবে রেডিয়োর চাকরিটা যদি হয়ে যায় তাহলে হয়ত আর অভিনয় হবে না৷ কিন্তু হয়েছিল ঠিক এর উল্টো, সিনেমার চাপে অনিল চট্টোপাধ্যায় সেদিন রেডিয়োয় ঘোষকের চাকরিটা করেন নি আর সেই চাকরি পেয়েছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়৷
ইন্টারভিউ দেওয়া প্রার্থীদের মধ্যে অনিল চট্টোপাধ্যায় পেয়েছিলেন প্রথম স্থান,সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় হলেন দ্বিতীয় ৷ বন্ধুত্বে ক্রমে আরও জোরালো হয়েছে,পরস্পরের বাড়ি যাওয়া থেকে লম্বা সময় অন্তরঙ্গ আড্ডা চলেছে৷ ১৯৬৪সালে সৌমিত্র-এর পরিবার পুরী বেড়াতে গিয়েছিলেন,সেই যাত্রায় তাদের সাথী হয়েছিলেন সস্ত্রীক অনিল৷ চলত একসঙ্গে হইহই করে সমুদ্রে স্নান,দুই পরিবারের প্রবীণরা নিজেদের মধ্যে কথায় ব্যস্ত থাকতেন তখন দুই বন্ধু সমুদ্রের তীর ধরে হেঁটে চলে যেতেন অনেক দূর৷ নানা বিষয় দু'জনের মুক্তমনে আলোচনা হত, বয়সে সৌমিত্র একটু ছোট অনিল চট্টোপাধ্যায়ের তুলনায়,কিন্তু বয়সের ব্যবধান কোনওদিন তাদের বন্ধুত্বে প্রাচীর হতে পারেনি৷
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের নিজের কথায় 'অনেক পরে অভিনেতৃ সঙ্ঘ আর শিল্পী সংসদ আলাদা হয়ে গেল,তখনও অনিল শিল্পী সংসদের নেতা বলে আমাদের ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব কখনও ক্ষুণ্ণ হয়নি'৷
খেলাধূলোর প্রতি অনিল বাবুর ছিল অমোঘ টান,কম যেতেন না সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আর সেই টানেই একসময় স্টুডিয়োর মধ্যে ব্যাডমিন্টন খেলার আসর গড়ে উঠেছিল সেই বিষয়েও প্রধান উদ্যোগীদের অন্যতম অনিল চট্টোপাধ্যায়৷ প্রথম কোর্ট তৈরি হয়েছিল রাধা ফিল্মসের স্টুডিয়োয়,পরে এন টি আর ওয়ানে৷ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী দীপা সেখানে ব্যাডমিন্টন খেলতেন,অনিল,দিলীপ খেলেছেন৷
শুধু ব্যক্তিগত জীবনে নয় সিনেমায় সৌমিত্র-অনিল পরস্পরের বন্ধু হিসেবে অনেক চরিত্রে অভিনয় করেছেন,বন্ধু হিসেবে তাদের অভিনীত প্রথম ছবি 'দেবী'৷ আবার 'স্বরলিপি'ছবিতে নায়িকার দাদা অনিল চট্টোপাধ্যায়৷ অভিনেতা অনিল চট্টোপাধ্যায়কে অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়,বিশেষত 'দেবী','মহানগর','মেঘে ঢাকা তারা', 'কোমল গান্ধার'তাঁর অভিনয়ে উচ্ছ্বাস চেপে রাখতে পারেন নি,কিন্তু তাঁর চোখে বন্ধু অনিলের শ্রেষ্ঠ অভিনয় 'পোস্টমাস্টার'৷
কিংবদন্তি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণায় 'সব ভুলে যেতে পারি কিন্তু পোস্টমাস্টারকে কী করে ভুলব?'
একই রকম মুগ্ধতা সত্যজিৎ রায়ের 'কাঞ্চনজঙ্ঘা 'ছবির প্রাণচঞ্চল,মজার এবং হৃদয়স্পর্শী অনিলে৷বহুমুখী প্রতিভার মানুষ,নায়ক,চরিত্রাভিনেতা অনিল চট্টোপাধ্যায় ছিলেন মেধাবী ছাত্র৷ চমৎকার দখল ছিল ইংরেজি ভাষায়,খুব ভাল ছবি আঁকতেন,লিখে রাখতেন রোজনামচার ডায়েরি৷ নিজের লেখা বইয়ে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন'ভবিষ্যতে অনিলের ডায়েরি যদি সুসম্পাদিত ভাবে প্রকাশিত হয় তাহলে শুধু তার ব্যক্তিগত জীবনের কাহিনী নয় আমাদের অভিনয় করার সময়টার ইতিহাসও ধরা পড়বে বলে আমার বিশ্বাস'৷আজ অনিল নেই,রেখে গিয়েছেন অনেক স্মৃতি,অনেক ভালোলাগা৷
সংকলনে—অরুণাভ সেন৷
©ভালবাসি বাংলা
গ্রন্থঋন,কৃতজ্ঞতা-চরিত্র সন্ধানে,সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়৷

Post a Comment

0 Comments