কিছু মানুষ পৃথিবীতে আসে কষ্ট পাওয়ার জন্য। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাদেরকে কষ্টই পেয়ে যেতে হয়। সুনেত্রা আমাদের চলচ্চিত্রের এক অনবদ্য তারকার নাম। কিন্তু তার কথা আমরা ভুলে গেছি স্বার্থপরের মত। অভিনেতা জায়েদ খান নিজ উদ্যোগে সুনেত্রার পরপারে চলে যাওয়ার খবরটি আমাদের দিলেন। সুনেত্রার প্রয়াণ ঘটে ২০ এপ্রিল। অথচ আমরা সেই খবর জানলাম প্রায় দেড়মাস পর। তাও ছোটভাই জায়েদ খানের মাধ্যমে। মিডিয়া বা সাংবাদিকদের তাতে কোনো মাথা ব্যথাই নেই। এই প্রজন্ম সুনেত্রাকে চেনেনা। তারা চেনে অর্ধ ন্যাংটো রাবিশ কুঅভিনেত্রীদের। ডাগর ডাগর চোখের কারণে সুনেত্রাকে ভীষণ পছন্দ করতাম। মনে পড়ে "সর্পরানী"নামে তার একটা ছবি ছিল। সেই ছবিতে সুনেত্রার সর্পিল দৃষ্টিতে কলিজা শুকিয়ে গিয়েছিল ভয়ে। সুনেত্রার ডাবল রোল ছিল সম্ভাবত। তার মায়ের ভূমিকায় ছিলেন পাকিস্তানি অভিনেত্রী নীলো। সুনেত্রা ওপার বাংলা থেকে এসেছিলেন। যতগুলো সিনেমা তিনি করেছেন সবগুলোই দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছিল। ফারুক জাফর ইকবাল জসীম ইলিয়াস কাঞ্চন মাহমুদ কলিদের সাথে জুটি হিসেবে ছিলেন খুব স্বতস্ফুর্ত। এদেশের গুণী নির্মাতা অমতাজ আলী, দেলোয়ার জাহান ঝন্টু, আওকাত হোসেন, দারাশিকো'র ছবিতে অভিনয় করে প্রচুর সমাদৃত হয়েছেন তিনি।
সুনেত্রা তার ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে অভিনেত্রী তন্দ্রা ইসলামের বাসায় ছিলেন অনেকদিন। তখন তিনি ছিলেন রিনা মন্ডল। একদিন এফডিসিতে তার সঙ্গে পরিচয় হয় শামসুল হক মোহন নামে এক ব্যক্তির। সুনেত্রার সাথে তার মন দেয়ানেয়া হয়। মোহন নিজেকে ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দিয়েছিলেন। সম্ভবত ১৯৮৮ সালে তারা গোপনে বিয়ে করেন। হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে রীনা মন্ডল থেকে হন ফাতেমা হক। কিন্তু পর অল্প কিছুদিন সংসারে সুখ ছিল। কিন্তু এরপর বেরিয়ে আসে মোহনের দানবীয় চেহারা। যেসব ছবিতে সুনেত্রা সাইন করতেন সেসব ছবির সাইনিং মানিসহ সব পারিশ্রমিক মোহন নিতেন। সুনেত্রাকে ফুটি কড়িও দিতেন না। প্রচন্ড হীনমন্যতায় ভুগতেন মোহন। এফডিসিতে যখন শ্যুটিং চলতো শ্যুটিংয়ের বাইরে সুনেত্রা তার কো-আর্টিস্টদের (নায়ক) সাথে হেসে গল্প করতে পারতেন না। মোহন তাকে গল্প করতে দেখলেই রাতে বাসায় ফিরে কোমরের বেল্ট খুলে পেটাতেন। এভাবে সুনেত্রার পিঠে প্রায় দাগ পড়ে যেত। মদ্যপ মোহন সুনেত্রাকে বাধ্য করতেন ধনী ব্যবসায়ীদের সাথে সময় কাটাতে। কিন্তু উচ্চশিক্ষিতা সুনেত্রা সেটা মেনে নিতে পারেননি। শুরু হয় পারিবারিক অশান্তি।
লোভী ধূর্ত মোহনের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ডিভোর্স দেন সুনেত্রা। সুনেত্রার পাসপোর্ট আগুনে পুড়িয়ে ফেলেন মোহন। যাতে করে সুনেত্রা ভারতে ফিরে যেতে না পারেন। তাকে প্রাণনাশের হুমকিও দেন মোহন। সুনেত্রা খুব গোপনে বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে ভারতে রওনা হন। কিন্তু পাসপোর্ট না থাকায় বিএসএফ তাকে আটকে দেয়। সুনেত্রা বিএসএফের এক অফিসারকে তার দুর্দশার কথা খুলে বলেন। সেই অফিসারের নাম ছিল সুরেশ কুমার। তিনি সুনেত্রাকে সাহায্য করেন কলকাতায় ঢুকতে। সুরেশ কুমারের সাথে সুনেত্রার সখ্যতা হয়। সখ্যতা রুপ নেয় প্রেমে। ১৯৯৭ সালে সুরেশ কুমারকে বিয়ে করেন সুনেত্রা। এবার তার নাম হয় রিনা সুনেত্রা কুমার। মোটামুটি সুখেই ছিলেন সুরেশের সাথে। এখানেও তারা নিঃসন্তান দম্পতি ছিলেন। কলকাতার ভবানীপুরে সুনেত্রা একটা বাড়ি কিনেছিলেন। কিন্তু চলচ্চিত্র থেকে অনেকটা সরিয়ে রেখেছিলেন নিজেকে। যদিও কলকাতায় যখন বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না রিমেক হয় সেখানে সুনেত্রার অভিনয় করার কথা ছিল। কিন্তু তিনি চিকেন পক্সে আক্রান্ত হওয়ার কারণে ছবিটি ছেড়ে দেন। তার জায়গায় স্থলাভিষিক্ত হন অঞ্জু ঘোষ।
সুনেত্রা নিজেকে সম্পূর্ণভাবে আইসোলেটেড করে ফেলেন। সাংবাদিকদের এড়িয়ে চলতেন। কাউকে ছবি তুলতে দিতেন না। এরই শরীরে কিছু জটিল রোগ হানা দেয়। সম্ভবত ক্যান্সার বাসা বাঁধে তার শরীরে। কিডনিও আক্রান্ত হয়। অনেকদিন কিডনি ডায়ালাইসিস করেছেন। কিন্তু সুস্থ জীবনে আর ফিরতে পারেননি আশি নব্বই দশকের সুনয়না ও সুঅভিনেত্রী সুনেত্রা। একবুক অভিমান নিয়ে বাংলাদেশ ছাড়লেন। শত অনুরোধেও আর ফিরলেন না। এত ভালো ভালো কাজ তিনি করেছেন একটা পুরস্কারও তার ভাগ্যে জুটলো না। মৃত্যুর আগের মর্মান্তিক দু'তিনটে ছবিতে দেখলাম। মাথায় চুল বলতে কয়েক গাছি চুল অবশিষ্ট ছিল। মুখে ছোপ ছোপ কালো দাগ। জটিল রোগে পর্যুদস্ত মুখাবয়ব। কিন্তু তারপরেও চোখের দৃষ্টিতে কি অদ্ভুত মায়া। স্রষ্টা তার আত্মাকে শান্তি দিন।।।
ছবি ও লেখাঃ Mili Sultana আপু।।।।
0 Comments
Thank you for your message, I see all your messages, it is not possible to reply many times due to busyness, I hope I will reply to everyone in time, thank you for being with me. Thanks you watching my content. Please like, Follow, Subscribe.